Tuesday, September 7, 2010

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ

চার
As industrialism gradually undermined religious values, along with their ideological power, it proved necessary to find a substitute for this most astonishingly successful of all symbolic systems; and from the Romantics onwards, it was known as culture. Most aesthetic concepts are theological ideas in disguise. Hence the religious, pseudo-transcendent language in which art has so often been discussed in these distinctly non-transcendent modern times.


Terry Eagleton , The New Statesman, 20 June 2005


পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদের raison d'etre কিন্তু আমি এখনও দেখাইনি। ওটা সাসপেন্স ভেবে নিন, যাতে পাঠক লেখার শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য হন। এও ভাবতে পারেন যে অনেকগুলি কথা আগে না বললে ও কথায় পৌঁছনো যাবে না। সলতে পাকানো এখনও শেষ হয়নি তো।

বাঙালি বর্ণহিন্দু দুয়েকবার মোঘল-পাঠানের সঙ্গে টক্কর দিলেও মোটের ওপর অনুগত ছিল। এরপর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজকে সরিয়ে ইংরেজের ক্ষমতায় আসায় বাঙালি বর্ণহিন্দুদের সমাজপতিরা সক্রিয় সমর্থন দেন। এই সময় থেকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের নৈকট্যের ন্যারেটিভ শুরু। মনে রাখা দরকার যে সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সেপাইরা ইংরেজ প্যাঁদানোর পরেই বাঙালি প্যাঁদাতেন। উকিল, ডাক্তার, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষক ইত্যাদি সমস্ত পদই বাঙালি বর্ণহিন্দুরা অলঙ্কৃত করে অত্যন্ত সফলভাবে ব্রিটিশদের প্রিয় comprador শ্রেণি হিসেবে উঠে আসে। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের মাত্র ত্রিশ চল্লিশ বছরের মধ্যেই এই অবস্থার এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। কেন ও কিভাবে ঘটে, তা একটা লম্বা গল্প, তবে সংক্ষেপে বললে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করা হবে, অথচ তার শ্রেষ্ঠ দার্শনিক চিন্তাগুলি থেকে বাঙালি হিন্দু গা বাঁচিয়ে চলবে, এমনটা ভাবা মূর্খামি। তাই স্বরাজের স্পৃহা, আধুনিক জাতীয়তাবাদ, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার আদর্শ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নির্ভর ভাষা চেতনা, এমনকি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধে ধর্মের পুনর্জাগরণ (রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ) ইত্যাদি বিষয়গুলো অনেকটাই পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে তৈরি হওয়া ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এর আগে আমাদের যে ধর্মীয় রিফর্মেশন আন্দোলন হয়, ব্রাহ্ম আন্দোলন, তা ছিল মূলত ইংরেজ ঘনিষ্ঠ বাঙালি বর্ণহিন্দুর প্রচেষ্টা। তবে সেই কারণে তাকে খাটো করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তাদের সম্পর্কে একথাও বলতে হয় যে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি যুবকদের ক্রিশ্চান হয়ে যাওয়ার প্রবণতা তারা সফলভাবে রোধ করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে না বলে পারছি না যে তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপরে কিঞ্চিত কসমেটিক সার্জারি ঘটিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আমাদের উদারপন্থি ভারতীয়তাবাদি লোকগুলি তা বেমালুম চেপে যান, বা হয়ত খবরই রাখেন না।
একবার দেখেছিলাম রবীন্দ্রনাথের বাংলার মাটি বাংলার জলের বিকৃত হিন্দি অনুবাদ দেখানো হচ্ছে দূরদর্শনের ন্যাশনাল নেটওয়ার্কে , দেশ কি মিট্টি দেশ কি জল! ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশনের বহরটা ভাবুন একবার! এটা ইতিহাসের যে কোনও ছাত্রের কাছে অজানা নয় যে বঙ্কিমের বঙ্গমাতাকেই ভারতমাতা বলে বাজারে ছাড়া হয়েছিল, আর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যবহৃত স্লোগান বন্দেমাতরম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের স্লোগান হয়ে ওঠে। স্বদেশি কথাটাই তো বাঙালি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। তা একসময় ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াইতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন হয়েছিল যখন, তখন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয়রা বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে ধার নিয়েছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু আজ যদি সেই ভারতীয় জাতীয়তার দোহাই দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়, তা ইতিহাসবিরুদ্ধ, এবং তা মোটেই সহ্য করা যায় না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে যে যতদিন বাঙালি বর্ণহিন্দু দালালি করেছেন, ততদিন সব ঠিকঠাক চলেছিল। যেই ইংরেজের বিরুদ্ধে গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি দলিতদের প্রতি ইংরেজের উস্কানি শুরু হল। বর্ণহিন্দুর দোষ অসীম, কোনও সন্দেহ নেই। একচক্ষু হরিণ। শুধু ইংরেজের আধিপত্যই দেখেছি, নিজের বাঁদরামি দেখিনি, ঘরের কাছে প্রতিবেশি নিম্নবর্ণ কিভাবে বেঁচে আছে, কেয়ার করিনি (রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী মনে পড়ে)। তাই বর্নহিন্দুর নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার শেষে দেশভাগই হওয়ার ছিল। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিকে কংগ্রেসের সমর্থন না দেওয়া ছিল ইতিহাসের অমোঘ ইঙ্গিত। এরপর বাংলায় মুসলিম লিগের রাজত্ব, বাঙালি হিন্দুদের ওপরে নোয়াখালির মত কুৎসিত জেনোসাইড, এস সি ফেডারেশনের সমর্থনে বাংলাভাগ, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের পাকিস্তানের আইনমন্ত্রীর পদগ্রহণ ও এরপর তাঁর ট্র্যাজিক জীবন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে কয়েক বছরের মধ্যে চার মিলিয়ন হিন্দুর (যার অধিকাংশই নিম্নবর্গীয়, যারা দেশভাগের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন) উৎখাত হওয়া, এ সবই আমাদের ইতিহাসে থেকে যাবে। উদবাস্তু বাঙালি নমশূদ্রকে কিভাবে জ্যোতির বসুর পার্টি ও পুলিস মরিচঝাঁপিতে গণখুন করেছে, সেটাও দেখতে হবে। ইতিহাসকে কম্বলচাপা না দিয়ে ফিরে পড়ার সৎসাহস দেখানো দরকার।

ভারত একটি বহুজাতিক দেশ। এখানে প্রতিটি জাতিই সেকথা জানে ও বোঝে। শুধু বাম-লিবেরাল বিশ্বমানবিকরা বোঝেন না। দিল্লিতে নিজের প্রদেশের স্বার্থরক্ষা সবাই করেন, শুধু বাঙালি এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামান না। সবাই নিজের প্রদেশের কর্মপ্রার্থিকে অগ্রাধিকার দেন, শুধু বাঙালিই দেন না। ফলে ভারতে বাঙালির কোনঠাসা হওয়ার এক চমৎকার পরিবেশ বাঙালিই তৈরি করে দেন। একসময় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালিরাই চালাতেন, আজ সেখানে বাঙালির দশা দেখলে সেই টেনিদার কথাটা মনে পড়ে, বাঙালি পাগল না বাঙালির পেট খারাপ বোঝা সত্যি খুব কঠিন।
কিছুদিন আগে, সম্ভবত এ বছরের (২০১০) মার্চ মাসে আনন্দবাজার পত্রিকায় দিল্লিতে বাংলা চর্চার বেহাল দশা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বের হয়েছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স করার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু যেহেতু বাংলা নিয়ে পড়লে প্রায় কোনও ভবিষ্যতই নেই, তাই ছাত্ররা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। প্রবাসী বাঙালিদেরও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, এমনকি যে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি রয়েছে, তারাও ধুঁকছে। এ জিনিস তামিলদের ব্যাপারে ভাবা যায় না, স্রেফ ভাবা যায় না। হিন্দু বাঙালির পরিচয় সঙ্কটের কারণে, তার উদারতা, বিশ্বজনীনতা ও বামপন্থার কারণে যদি ভারতে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির বিসর্জন যাত্রা ঘটে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, সেক্ষেত্রে আস্তিন গোটানোর সময় এসেছে।

আমাদের এক ফেসবুক বন্ধু, যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনীয়তাই অস্বীকার করেছেন, তিনি আরও একটি মন্তব্য করেনঃ যে বাঙালিরা নিজ ক্ষেত্রে ব্যর্থ তারাই বাকি বাঙালিদের কাছে জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে নিজেদের বাঁচাতে চান, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চান। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ হল অক্ষমের বৃহন্নলা ক্রন্দন। যেহেতু এই মন্তব্য আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত একটি স্টেটাস মেসেজের প্রেক্ষিতে এসেছিল, সন্দেহ হয় তিনি আমাকেই একজন ব্যর্থ বাঙালি ঠাউরেছেন এবং মনে করেছেন যে আমার বোধহয় নিতান্ত ল্যাজেগোবরে অবস্থা, তাই আমি বাকি বাঙালিদের উদ্দেশ্যে আকুল ক্রন্দন করছি, ওগো, আমাকে সাহায্য কর, বাঙালি বাঙালিকে না দেখিলে কে দেখিবে। যেন এমন করলে সেটা অপরাধ হত! এই মন্তব্য হেসে ওড়াবেন না, এই মন্তব্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ। এর মাধ্যমে বিশেষ করে দক্ষিনবঙ্গের, কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালির এক মারাত্মক অসুখ ধরা পড়ে, সে অসুখের নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়াতেই পারবে না। কলকাতার বাঙালি ক্ষমতার আরাধনায় (মিশেল ফুকোর পাওয়ার/নলেজ বিন্যাস এখানে খুব জরুরি ধারণা যদি প্রোফেশনাল মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনধারণ বুঝতে চান) বহু আগে সমব্যথা বিসর্জন দিয়েছে। যদি কোনও দুস্থ বিহারি/তামিল তার জাতের কোনও ক্ষমতাবান ব্যক্তির কাছে সাহায্য চান, তিনি সেটা পাবেন এই সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। যদি কোনও বিপন্ন বাঙালি যুবক বা যুবতী কোনও বয়স্ক বাঙালির কাছে সাহায্য চান, কিছু মুফত জ্ঞান ছাড়া উপহাস পাবেন, কিন্তু কোনও সাহায্য পাবেন না, সে সম্ভাবনা নিরানব্বই দশমিক নয় নয় শতাংশ। আমরা মানুষ চিনি তার প্রতিষ্ঠা দিয়ে, এবং প্রতিষ্ঠা মানে অবশ্যই চাকরি, এবং প্রতিষ্ঠা মানে সংগ্রামরত মানুষ নয়, ক্ষমতার দালালি করে জুড়িগাড়ি হাঁকানো মানুষ। এবং যেহেতু বাঙালি আর্থিক দিক দিয়ে পরনির্ভর, পরজীবি, সে অন্যের প্রতিষ্ঠানে ভৃত্যের কাজ করে, তাই সে প্রতিষ্ঠা নিয়ে ম্যানিয়ায় ভোগে। সে ব্যর্থ মানুষের প্রতি সমব্যথা দেখায় না, আর দালালের স্বাজাত্যবোধ থাকলে তো সূর্য পশ্চিমে উঠবে। বাঙালির হিন্দি ইংরেজির প্রতি মুক্তকচ্ছ হওয়ার প্রধান কারণও এই, এ দুটি জানলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, সে বুঝেছে। বাংলা ক্ষমতার ভাষা নয়, কাজেই সেটা শেখার কি প্রয়োজন!

যতক্ষণ তুমি ব্যর্থ, তুমি মানুষই নও। যেই তুমি বড়রকম সাফল্য পেলে, তুমি আগমার্কা আনন্দবাজার ছাপের সেরা বাঙালি, সে তুমি বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে ছাই জানো আর না জানো! হীরক রাজার দেশে একটা ডায়ালগ ছিল, 'নাম জানো না তো! যার নাম নাই, তার কথার দাম নাই!' বাঙালির সাফল্য ম্যানিয়া, তার সুপারম্যানিয়া (শিব্রাম মস্কো বনাম পন্ডিচেরিতে এই শব্দ কয়েন করেছিলেন, সুপারম্যান নিয়ে বাঙালির যে বিশেষ ম্যানিয়া তাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এই শব্দটি ধার না করে পারা যায় না), বাম-লিবেরালের সুখী complacent বালিগঞ্জ যোধপুর সল্টলেক নিউ টাউন কেন্দ্রিক জীবনচর্চা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথে প্রধান বাধা। সংগ্রামরত বাঙালি, বিপন্ন বাঙালি, বেকায়দায় পড়া বাঙালির জন্য সমবেদনা না দেখিয়ে, তাকে উৎসাহ না দিয়ে, সাহায্য না করে কেবল তেলা মাথায় তেল দেওয়া নামক যে মহামারী আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মূলে আক্রমণ করছে, তাকে চরম জোরে লাথিয়ে গঙ্গাপার না করালে আমাদের বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হবে। এ মহামারীর মূলে আছে মুৎসুদ্দিপনা, সেটা মনে রেখে লাথিটা মারতে হবে।

উল্লেখ করা ভাল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফলে বাকি ভারতবাসি বা বিশ্ববাসির সঙ্গে কোনও বিভেদ আসার কথা নয়, কারণ একজন ভাল বাঙালি সঙ্গী হিসেবে খুব আকর্ষণীয়, সেটা আপনাকে অন্যভাষীরাই বলে দেবেন। আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই শিরোনাম নিয়ে একটু বলে রাখি, আমি চাই ভারত রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাঙালিরা যেন পশ্চিমবঙ্গকে তাদের স্বার্থরক্ষকের ভূমিকায় দেখেন, সমদরদীর ভুমিকায় দেখেন। যিনি এই লেখার শেষ অবধি পড়বেন, তিনি নিশ্চয়ই ভাববেন না যে আমি বহির্বঙ্গের বাঙালিকে চাপা দিয়ে স্রেফ এক কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালিয়ানায় আস্থা রাখি। তবে পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা আমাদের পীঠস্থান, তার প্রতি কোনও বিদ্বেষ রাখা অনুচিত, বরং সেখানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন কিভাবে আনা যায়, সেই চেষ্টাই করা ভাল। এও বলি, বাঙালিয়ানার, বাঙালি সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ যে দরকার, সেটা প্রবাসী বাঙালি হয়ে আমি অবশ্যই হাড়ে হাড়ে বুঝি।

কিন্তু বাঙালির ইতিহাস এও সাক্ষ্য দেয়, যে কোনও বিষয়ে আমাদের একমত হওয়া বড় মুশকিল। আমাদের সব বিষয়ে দলাদলি, যার জন্যই আক্ষরিক অর্থে কোনও দলই গড়ে ওঠেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই প্রায়োগিক সমস্যার কোনও সহজ সমাধান হবে না। একটু ইতিহাস ঘেঁটে যদি দেখি, এই কাঁকড়াবৃত্তির কারন খুঁজি, এর সূত্রপাত সেন আমলে। আমাদের সমাজকে বহুভাগে বিভক্ত করে সেনদের বোধকরি শাসনে সুবিধাই হয়েছিল। জমিদারিপ্রথা এল মধ্যযুগে। জাতপাত ও জমিদারিপ্রথার ফলে এই সর্বনাশ ঘটল যে আমাদের সংগঠিত হওয়ার প্যারামিটারগুলি খুবই ক্ষুদ্র থেকে গেল। এবং এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

বাঙালি যে স্বপরিচয় নিয়ে স্বস্তিবোধ করে না, তার একটা বড় কারণ সে অন্য উপপরিচয়ে জীবনধারণ করে থাকে। সে অমুকের ঘনিষ্ঠ, সে তমুকের বংশধর, সে অমুক পদবীভূক্ত কুলীন বামুন বা কায়েত, সে সাউথ পয়েন্ট বা ডন বস্কো বা প্রেসিডেন্সি বা সেইন্ট জ়েভিয়ার্সে পড়েছে (আমি দিল্লির এক বাঙালি অধ্যাপিকার সঙ্গে আলাপের সময় দেখেছিলাম যে তিনি এই জেনেই উল্লসিত যে তাঁর মত আমিও যাদবপুরে পড়েছি, তিনি যাদবপুরিয়ান বলে একটি কথাও ব্যবহার করলেন। তিনি জানেন না যে বাংলায় পুরিয়া শব্দটা একটা স্ল্যাং! এবং মজার ব্যাপার হল একজন স্বজাতীয়র সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি একটি বাংলা কথাও ব্যবহার করলেন না, সমস্ত কথা চালালেন ইংরেজিতে, যদিও আমি বাংলাতেই বলছিলাম), বা সে বিলেত-অ্যামেরিকার অমুক কলেজের প্রাক্তনী, সে অমুককে তার গডফাদার মেনেছে এবং সে তমুক গোষ্ঠীতে নাম লিখিয়েছে। কলকাতায় আমার পড়াশোনার সময় দেখেছি, কোনও না কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির নেকনজরে না পড়লে সেখানে অ্যাকাডেমিক্সে বা মিডিয়াতে ঢোকাই যায় না। বাংলায় এখনও জমিদারিপ্রথা চলছে, গোষ্ঠীপ্রথা চলছে। আমাদের কিংবদন্তিসম ব্যক্তিত্বরা সবাই এই জমিদারিপ্রথাকে লালন করেছেন, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। সিপিএম এসে এই জিনিসটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে আর কি। পুঁজিবাদের প্রয়াসই থাকে এরকম সামন্তধর্মী নেক্সাস বজায় রাখা, কারণ পুঁজি তো মানুষে মানুষে টাকা ছাড়া অন্য সম্পর্ক স্বীকার করে না, অথচ তাতে কাজ চালানো অসম্ভব, তাই পুরোনো সমাজের থেকে এই বদ সম্পর্কগুলো (পেট্রিয়ার্কি ও ফ্যামিলি সহ) সে ধার নেয়। এটা বিখ্যাত মার্ক্সিয় ঐতিহাসিক এরিক হবসবমের মত। আর বাংলায় এত গোষ্ঠীর, জমিদারের, সমাজপতির, মোড়লের ছড়াছড়ির কারণ কি, সে প্রসঙ্গে আমার মনে হয় আমাদের অতি-উর্বরা, বহুফসলা, সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা resourceful মাতৃভুমির জলহাওয়া এর জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী হতে পারে।

মার্ক্সিয় চিন্তায় ধর্ম নিয়ে সেই এঙ্গেলস থেকে আজকের টেরি ইগলটন পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে, আমি চাই হিন্দু বাঙালির ওপরে সেই চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে একটি সুসংহত কাজ হোক, যাতে অনেকগুলি বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা যাবে। আমরা, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বাসিন্দা যে জন্মসূত্রে হিন্দু বাঙালি সেটা লুকোছাপা করার চেষ্টা হাস্যকর, তাকে ট্যাবু বানিয়ে তোলা এবং তার উল্লেখ নিষিদ্ধ করা এবং তা নিয়ে এক ফ্রয়েডিয় অস্বস্তিতে ভোগা আমাদের শিক্ষিত বাম-লিবেরাল অংশটির এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর ফলে এক ভয়াবহ গ্যাপ তৈরি হয়েছে, বাকি বাঙালির সঙ্গে এই অংশটির। এরা বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না বা বাবা তারকনাথ জাতীয় বাংলা ছবি কেন রইরই করে চলে সেটা ভেবে অবাক হয়ে যান। দমদমে যখন বিজেপি জেতে, তখনও এই বুর্জোয়া লিবেরাল বামপন্থিরা অবাক হয়ে যান। সাধে কি আর নরেন্দ্রনাথ দত্তর পিতাঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, বড় হয়ে আর যা-ই হোস না কেন বাবা, অবাক হোস না।

আলোচনার এই অংশের শুরুতে ব্রিটিশ সমালোচক টেরি ইগলটনের যে বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছি, সেখানে ইগলটন ধর্মের সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে কিছু বলেননি, যদিও অন্যত্র এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। মানুষ সামাজিক সঙ্ঘবদ্ধ প্রাণী, অ্যা্রিস্টোটল বলেছিলেন political animal। একতাবদ্ধ হওয়ার একটি সুত্র চাই। আধুনিককালে যেকোনও পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট সমাজে সেই সূত্রটি যোগায় ভাষা ও সংস্কৃতি। ভাষা যে শুধু দুটো একটা কবিতা গল্প লেখার জন্য নয়, ভাষা যে আমাদের মস্তিষ্কের নিয়ামক, আমাদের চিন্তার নিয়ন্ত্রক, তা যে এমন এক বিশাল মহাবিশ্ব যার ওপারে যাওয়ার ক্ষমতা মানুষের কখনও হয়ই না, এগুলো বিংশ শতাব্দির সমস্ত দর্শন স্বীকার করেছে, Saussure থেকে Lacan সবাই তা মেনেছেন। অবশ্য যে সমাজে এনলাইমেন্ট ঘটেনি, সেখানে ধর্মই সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রধান মিডিয়াম হয়ে থেকে যায়, যেমন গোঁড়া মুসলিম দেশগুলি। এইজন্য ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গত প্রায় একশো বছর ধরে মানুষের মধ্যে এক কাল্পনিক কমিউনিটি (বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের কথায়)বানিয়ে তোলে। কাল্পনিক, কারন পাঠক, আপনি ও আমি এক যোগসূত্র কল্পনা করছি। মনে করছি, কোনও একটি কারণে আপনার ও আমার মধ্যে বেরাদরি স্থাপিত হয়েছে। সেটা আমাদের বিরাট মানবিক প্রাপ্তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু বাংলা ভাষা সংস্কৃতিকে এই হিন্দি ইংরেজির রাজত্বে রক্ষা করার জন্য নয়, তা শুধু গ্লোবালাইজ়েশনের যুগে মৃত্তিকা থেকে উঠে আসা প্রতিরোধ নয়, তা আমাদের মধ্যে এক কমিউনিটির জন্ম দেয়। তা অসংখ্য নিম্নবর্গীয় বাঙালির ক্ষমতায়ণের লক্ষ্যে এক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, তাই মার্ক্সিয় চিন্তায় অপরিহার্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ব্যক্তি বাঙালির alienation ঘোচায়। তা আমাদের ইতিহাসের শিহরণ, তা আমাদের পরিচয়ের উল্লাস। এ মাতৃদুগ্ধের মত, তাই কোনও বিকল্প হয় না।

এই লেখাটি এখানেই শেষ হচ্ছে, তবে আলোচনা শেষ নয়। সবে শুরু।

No comments: