Sunday, September 19, 2010

A Chance Encounter

A Brief Meeting: A Chance Encounter

There was this person whom i met only once. It was a chance encounter. I was in high school then.

1994. Summer vacation. I was at my aunt's place. It was a lazy afternoon. Barring me, a cousin brother, and two elderly ladies were there. The latter were having siesta. We two were discussing rather seriously about the respective girls we were in love with.
The calling bell rang. We went downstairs. We saw a young man. I didn't know him. My cousin did. He said, hey, it's you, ...da! (I don't remember the name he took. Henceforth I would refer to this young man as Nemo) Your rehearsal would start at five. No one is here yet.

My aunt and her husband (my mesho, as we call in Bengali) were involved in group theatre. Their house was the official address of their group. And all rehearsals were held there. So Nemo belonged to the theatre group, I understood.

He nodded. Yes, I know. Had nothing to do and nowhere to go, so thought of coming here a bit early.

Nemo was five feet ten or eleven, heavy in built, dark complexioned, and looked like either a college student, or fresh out of college.

We led him to the room where we two were seated earlier. We sat together.

He looked at me. Said in Bengali, I think I have heard about you. Aren't you the boy who reads Probir Ghosh?

Probir Ghosh was a familiar name to me. He was the chief of Rationalists' Association, and wrote a series of books called Oloukik Noy, Loukik (Not Supernatural, Natural).

I asked, is reading Probir Ghosh a kind of occupation?

Nemo smiled embarrassedly. I mean you read Probir Ghosh, right?

I said, yes. Among other books.

What is your idea about Probir, Nemo asked.

Well, I follow him closely. I consider myself a rationalist.

So, you are an atheist.

Yes.

So you want to take away religion from people's lives?

Yes, why not? That's superstition, right? I mean all religions are superstitions.

No doubt. But why do people invent them?

Well, in ancient times, they didn't understand the world around them, so they invented God.

And why is God still there when we understand the world?

Probably most people following religion still don't understand the world around them.

I agree. Then they still need God. The people who still don't understand the world.

I didn't understand this time what he wanted to say. I asked him to elaborate.

See, kerosene lamps are primitive. They are bad for health too. They go back to a time when people knew lesser science. So you want to take the kerosene lamps away. But you must provide that person with electricity, or some other better equivalent of a lamp.

I was taken aback. No one spoke like that before. I knew atheists who were dogmatic God-haters and religion-haters and who hated anything that was not rational and logical (My English teacher, who was a local leader of Rationalists' Association once demanded that the local book fair should not have ghost stories and supernatural books for children as they spoil the young minds. He didn't demand a ban on religious books since that would not be possible. Children could be policed, for the adults it's a tad difficult. However the local CPM leaders who ran the fair rather 'irrationally' turned this demand down). On the other hand I had people who were God-fearing. They disliked atheists. What he was saying was new to me. That before taking away religion, we have its replacement at hand. New indeed.


He added, and don't think religion was just about explaining nature, world, universe. It was also a way of life. It still is. Something we call ethics. Religion tried to answer some basic questions about existence. Stuff like philosophy. See, a human being needs some faith in life. Those who are well-read, can afford to do without it. They will probably take culture and knowledge as religion substitute. Those extremely poor or extremely rich can do in life without values as well. The But most common people cannot lead their lives without some sense of well-being. They derive it from religion, or God, or spirituality. Give it a thought.

The time for rehearsal was drawing near. People started appearing. The calling bell rang frequently. My cousin brother went downstairs.

He got up. Nice meeting you. Remember, an equivalent of religion has to made. The onus lies on atheists. Instead of abusing people's faith, engage with that. Try to see what can replace religion for the ordinary men and women. Without studying religion that won't happen. And don't consider rationality to be supreme. Give some consideration to human feelings. Desires and wounds which part of our existence. See if you are able to address them. Reason does not address them, but religion does. May be in opium-like manner, but still does.



I wasn't able to talk to him again. I saw him a couple of times during the times of a few theatrical productions of my aunt's group. Once or twice I met him at the green room or backstage, and he always beamed and waved. Later he left the group I guess.

But he has been an instrumental influence on me. Within just, say, 30 minutes, what he taught me, I guess, professors are not able to teach in entire semesters. And he was not any big person. He was just a young man, if not a college student, then, by all likelihood, unemployed. There is a saying, one swallow does not make a spring. If Kolkata is culturally and intellectually vibrant, its not only because of a few great personalities we produced intermittently. It is because of innumerable intellectuals you can meet in this city, here and there, upon chance encounters.

What he talked of was taken up by Terry Eagleton in Ideology of the Aesthetic (1990) as logic vs. aesthetic conflict, but of course I don't think he read Eagleton.

I remember him, as one of the finest teachers I have ever had. And today when I look back, a very strange coincidence attracts my attention. 1994 was the year when Nabarun Bhattachary'a Herbert was to be awarded Sahitya Academy award. Herbert takes up these very issues. But then Herbert would require a separate discussion.

N.B. Those who are interested may read my note 'Quo Vadis Bengal', where I argue that Bengal's recent political change is about choosing aesthetic over logic.

Tuesday, September 7, 2010

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ

চার
As industrialism gradually undermined religious values, along with their ideological power, it proved necessary to find a substitute for this most astonishingly successful of all symbolic systems; and from the Romantics onwards, it was known as culture. Most aesthetic concepts are theological ideas in disguise. Hence the religious, pseudo-transcendent language in which art has so often been discussed in these distinctly non-transcendent modern times.


Terry Eagleton , The New Statesman, 20 June 2005


পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদের raison d'etre কিন্তু আমি এখনও দেখাইনি। ওটা সাসপেন্স ভেবে নিন, যাতে পাঠক লেখার শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য হন। এও ভাবতে পারেন যে অনেকগুলি কথা আগে না বললে ও কথায় পৌঁছনো যাবে না। সলতে পাকানো এখনও শেষ হয়নি তো।

বাঙালি বর্ণহিন্দু দুয়েকবার মোঘল-পাঠানের সঙ্গে টক্কর দিলেও মোটের ওপর অনুগত ছিল। এরপর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজকে সরিয়ে ইংরেজের ক্ষমতায় আসায় বাঙালি বর্ণহিন্দুদের সমাজপতিরা সক্রিয় সমর্থন দেন। এই সময় থেকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের নৈকট্যের ন্যারেটিভ শুরু। মনে রাখা দরকার যে সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সেপাইরা ইংরেজ প্যাঁদানোর পরেই বাঙালি প্যাঁদাতেন। উকিল, ডাক্তার, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষক ইত্যাদি সমস্ত পদই বাঙালি বর্ণহিন্দুরা অলঙ্কৃত করে অত্যন্ত সফলভাবে ব্রিটিশদের প্রিয় comprador শ্রেণি হিসেবে উঠে আসে। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের মাত্র ত্রিশ চল্লিশ বছরের মধ্যেই এই অবস্থার এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। কেন ও কিভাবে ঘটে, তা একটা লম্বা গল্প, তবে সংক্ষেপে বললে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করা হবে, অথচ তার শ্রেষ্ঠ দার্শনিক চিন্তাগুলি থেকে বাঙালি হিন্দু গা বাঁচিয়ে চলবে, এমনটা ভাবা মূর্খামি। তাই স্বরাজের স্পৃহা, আধুনিক জাতীয়তাবাদ, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার আদর্শ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নির্ভর ভাষা চেতনা, এমনকি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধে ধর্মের পুনর্জাগরণ (রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ) ইত্যাদি বিষয়গুলো অনেকটাই পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে তৈরি হওয়া ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এর আগে আমাদের যে ধর্মীয় রিফর্মেশন আন্দোলন হয়, ব্রাহ্ম আন্দোলন, তা ছিল মূলত ইংরেজ ঘনিষ্ঠ বাঙালি বর্ণহিন্দুর প্রচেষ্টা। তবে সেই কারণে তাকে খাটো করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তাদের সম্পর্কে একথাও বলতে হয় যে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি যুবকদের ক্রিশ্চান হয়ে যাওয়ার প্রবণতা তারা সফলভাবে রোধ করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে না বলে পারছি না যে তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপরে কিঞ্চিত কসমেটিক সার্জারি ঘটিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আমাদের উদারপন্থি ভারতীয়তাবাদি লোকগুলি তা বেমালুম চেপে যান, বা হয়ত খবরই রাখেন না।
একবার দেখেছিলাম রবীন্দ্রনাথের বাংলার মাটি বাংলার জলের বিকৃত হিন্দি অনুবাদ দেখানো হচ্ছে দূরদর্শনের ন্যাশনাল নেটওয়ার্কে , দেশ কি মিট্টি দেশ কি জল! ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশনের বহরটা ভাবুন একবার! এটা ইতিহাসের যে কোনও ছাত্রের কাছে অজানা নয় যে বঙ্কিমের বঙ্গমাতাকেই ভারতমাতা বলে বাজারে ছাড়া হয়েছিল, আর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যবহৃত স্লোগান বন্দেমাতরম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের স্লোগান হয়ে ওঠে। স্বদেশি কথাটাই তো বাঙালি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। তা একসময় ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াইতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন হয়েছিল যখন, তখন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয়রা বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে ধার নিয়েছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু আজ যদি সেই ভারতীয় জাতীয়তার দোহাই দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়, তা ইতিহাসবিরুদ্ধ, এবং তা মোটেই সহ্য করা যায় না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে যে যতদিন বাঙালি বর্ণহিন্দু দালালি করেছেন, ততদিন সব ঠিকঠাক চলেছিল। যেই ইংরেজের বিরুদ্ধে গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি দলিতদের প্রতি ইংরেজের উস্কানি শুরু হল। বর্ণহিন্দুর দোষ অসীম, কোনও সন্দেহ নেই। একচক্ষু হরিণ। শুধু ইংরেজের আধিপত্যই দেখেছি, নিজের বাঁদরামি দেখিনি, ঘরের কাছে প্রতিবেশি নিম্নবর্ণ কিভাবে বেঁচে আছে, কেয়ার করিনি (রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী মনে পড়ে)। তাই বর্নহিন্দুর নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার শেষে দেশভাগই হওয়ার ছিল। ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিকে কংগ্রেসের সমর্থন না দেওয়া ছিল ইতিহাসের অমোঘ ইঙ্গিত। এরপর বাংলায় মুসলিম লিগের রাজত্ব, বাঙালি হিন্দুদের ওপরে নোয়াখালির মত কুৎসিত জেনোসাইড, এস সি ফেডারেশনের সমর্থনে বাংলাভাগ, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের পাকিস্তানের আইনমন্ত্রীর পদগ্রহণ ও এরপর তাঁর ট্র্যাজিক জীবন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে কয়েক বছরের মধ্যে চার মিলিয়ন হিন্দুর (যার অধিকাংশই নিম্নবর্গীয়, যারা দেশভাগের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন) উৎখাত হওয়া, এ সবই আমাদের ইতিহাসে থেকে যাবে। উদবাস্তু বাঙালি নমশূদ্রকে কিভাবে জ্যোতির বসুর পার্টি ও পুলিস মরিচঝাঁপিতে গণখুন করেছে, সেটাও দেখতে হবে। ইতিহাসকে কম্বলচাপা না দিয়ে ফিরে পড়ার সৎসাহস দেখানো দরকার।

ভারত একটি বহুজাতিক দেশ। এখানে প্রতিটি জাতিই সেকথা জানে ও বোঝে। শুধু বাম-লিবেরাল বিশ্বমানবিকরা বোঝেন না। দিল্লিতে নিজের প্রদেশের স্বার্থরক্ষা সবাই করেন, শুধু বাঙালি এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামান না। সবাই নিজের প্রদেশের কর্মপ্রার্থিকে অগ্রাধিকার দেন, শুধু বাঙালিই দেন না। ফলে ভারতে বাঙালির কোনঠাসা হওয়ার এক চমৎকার পরিবেশ বাঙালিই তৈরি করে দেন। একসময় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালিরাই চালাতেন, আজ সেখানে বাঙালির দশা দেখলে সেই টেনিদার কথাটা মনে পড়ে, বাঙালি পাগল না বাঙালির পেট খারাপ বোঝা সত্যি খুব কঠিন।
কিছুদিন আগে, সম্ভবত এ বছরের (২০১০) মার্চ মাসে আনন্দবাজার পত্রিকায় দিল্লিতে বাংলা চর্চার বেহাল দশা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বের হয়েছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স করার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু যেহেতু বাংলা নিয়ে পড়লে প্রায় কোনও ভবিষ্যতই নেই, তাই ছাত্ররা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। প্রবাসী বাঙালিদেরও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, এমনকি যে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি রয়েছে, তারাও ধুঁকছে। এ জিনিস তামিলদের ব্যাপারে ভাবা যায় না, স্রেফ ভাবা যায় না। হিন্দু বাঙালির পরিচয় সঙ্কটের কারণে, তার উদারতা, বিশ্বজনীনতা ও বামপন্থার কারণে যদি ভারতে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির বিসর্জন যাত্রা ঘটে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, সেক্ষেত্রে আস্তিন গোটানোর সময় এসেছে।

আমাদের এক ফেসবুক বন্ধু, যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনীয়তাই অস্বীকার করেছেন, তিনি আরও একটি মন্তব্য করেনঃ যে বাঙালিরা নিজ ক্ষেত্রে ব্যর্থ তারাই বাকি বাঙালিদের কাছে জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে নিজেদের বাঁচাতে চান, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চান। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ হল অক্ষমের বৃহন্নলা ক্রন্দন। যেহেতু এই মন্তব্য আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত একটি স্টেটাস মেসেজের প্রেক্ষিতে এসেছিল, সন্দেহ হয় তিনি আমাকেই একজন ব্যর্থ বাঙালি ঠাউরেছেন এবং মনে করেছেন যে আমার বোধহয় নিতান্ত ল্যাজেগোবরে অবস্থা, তাই আমি বাকি বাঙালিদের উদ্দেশ্যে আকুল ক্রন্দন করছি, ওগো, আমাকে সাহায্য কর, বাঙালি বাঙালিকে না দেখিলে কে দেখিবে। যেন এমন করলে সেটা অপরাধ হত! এই মন্তব্য হেসে ওড়াবেন না, এই মন্তব্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ। এর মাধ্যমে বিশেষ করে দক্ষিনবঙ্গের, কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালির এক মারাত্মক অসুখ ধরা পড়ে, সে অসুখের নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়াতেই পারবে না। কলকাতার বাঙালি ক্ষমতার আরাধনায় (মিশেল ফুকোর পাওয়ার/নলেজ বিন্যাস এখানে খুব জরুরি ধারণা যদি প্রোফেশনাল মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনধারণ বুঝতে চান) বহু আগে সমব্যথা বিসর্জন দিয়েছে। যদি কোনও দুস্থ বিহারি/তামিল তার জাতের কোনও ক্ষমতাবান ব্যক্তির কাছে সাহায্য চান, তিনি সেটা পাবেন এই সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। যদি কোনও বিপন্ন বাঙালি যুবক বা যুবতী কোনও বয়স্ক বাঙালির কাছে সাহায্য চান, কিছু মুফত জ্ঞান ছাড়া উপহাস পাবেন, কিন্তু কোনও সাহায্য পাবেন না, সে সম্ভাবনা নিরানব্বই দশমিক নয় নয় শতাংশ। আমরা মানুষ চিনি তার প্রতিষ্ঠা দিয়ে, এবং প্রতিষ্ঠা মানে অবশ্যই চাকরি, এবং প্রতিষ্ঠা মানে সংগ্রামরত মানুষ নয়, ক্ষমতার দালালি করে জুড়িগাড়ি হাঁকানো মানুষ। এবং যেহেতু বাঙালি আর্থিক দিক দিয়ে পরনির্ভর, পরজীবি, সে অন্যের প্রতিষ্ঠানে ভৃত্যের কাজ করে, তাই সে প্রতিষ্ঠা নিয়ে ম্যানিয়ায় ভোগে। সে ব্যর্থ মানুষের প্রতি সমব্যথা দেখায় না, আর দালালের স্বাজাত্যবোধ থাকলে তো সূর্য পশ্চিমে উঠবে। বাঙালির হিন্দি ইংরেজির প্রতি মুক্তকচ্ছ হওয়ার প্রধান কারণও এই, এ দুটি জানলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, সে বুঝেছে। বাংলা ক্ষমতার ভাষা নয়, কাজেই সেটা শেখার কি প্রয়োজন!

যতক্ষণ তুমি ব্যর্থ, তুমি মানুষই নও। যেই তুমি বড়রকম সাফল্য পেলে, তুমি আগমার্কা আনন্দবাজার ছাপের সেরা বাঙালি, সে তুমি বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে ছাই জানো আর না জানো! হীরক রাজার দেশে একটা ডায়ালগ ছিল, 'নাম জানো না তো! যার নাম নাই, তার কথার দাম নাই!' বাঙালির সাফল্য ম্যানিয়া, তার সুপারম্যানিয়া (শিব্রাম মস্কো বনাম পন্ডিচেরিতে এই শব্দ কয়েন করেছিলেন, সুপারম্যান নিয়ে বাঙালির যে বিশেষ ম্যানিয়া তাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এই শব্দটি ধার না করে পারা যায় না), বাম-লিবেরালের সুখী complacent বালিগঞ্জ যোধপুর সল্টলেক নিউ টাউন কেন্দ্রিক জীবনচর্চা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথে প্রধান বাধা। সংগ্রামরত বাঙালি, বিপন্ন বাঙালি, বেকায়দায় পড়া বাঙালির জন্য সমবেদনা না দেখিয়ে, তাকে উৎসাহ না দিয়ে, সাহায্য না করে কেবল তেলা মাথায় তেল দেওয়া নামক যে মহামারী আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মূলে আক্রমণ করছে, তাকে চরম জোরে লাথিয়ে গঙ্গাপার না করালে আমাদের বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হবে। এ মহামারীর মূলে আছে মুৎসুদ্দিপনা, সেটা মনে রেখে লাথিটা মারতে হবে।

উল্লেখ করা ভাল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফলে বাকি ভারতবাসি বা বিশ্ববাসির সঙ্গে কোনও বিভেদ আসার কথা নয়, কারণ একজন ভাল বাঙালি সঙ্গী হিসেবে খুব আকর্ষণীয়, সেটা আপনাকে অন্যভাষীরাই বলে দেবেন। আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই শিরোনাম নিয়ে একটু বলে রাখি, আমি চাই ভারত রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাঙালিরা যেন পশ্চিমবঙ্গকে তাদের স্বার্থরক্ষকের ভূমিকায় দেখেন, সমদরদীর ভুমিকায় দেখেন। যিনি এই লেখার শেষ অবধি পড়বেন, তিনি নিশ্চয়ই ভাববেন না যে আমি বহির্বঙ্গের বাঙালিকে চাপা দিয়ে স্রেফ এক কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালিয়ানায় আস্থা রাখি। তবে পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা আমাদের পীঠস্থান, তার প্রতি কোনও বিদ্বেষ রাখা অনুচিত, বরং সেখানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন কিভাবে আনা যায়, সেই চেষ্টাই করা ভাল। এও বলি, বাঙালিয়ানার, বাঙালি সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ যে দরকার, সেটা প্রবাসী বাঙালি হয়ে আমি অবশ্যই হাড়ে হাড়ে বুঝি।

কিন্তু বাঙালির ইতিহাস এও সাক্ষ্য দেয়, যে কোনও বিষয়ে আমাদের একমত হওয়া বড় মুশকিল। আমাদের সব বিষয়ে দলাদলি, যার জন্যই আক্ষরিক অর্থে কোনও দলই গড়ে ওঠেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই প্রায়োগিক সমস্যার কোনও সহজ সমাধান হবে না। একটু ইতিহাস ঘেঁটে যদি দেখি, এই কাঁকড়াবৃত্তির কারন খুঁজি, এর সূত্রপাত সেন আমলে। আমাদের সমাজকে বহুভাগে বিভক্ত করে সেনদের বোধকরি শাসনে সুবিধাই হয়েছিল। জমিদারিপ্রথা এল মধ্যযুগে। জাতপাত ও জমিদারিপ্রথার ফলে এই সর্বনাশ ঘটল যে আমাদের সংগঠিত হওয়ার প্যারামিটারগুলি খুবই ক্ষুদ্র থেকে গেল। এবং এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

বাঙালি যে স্বপরিচয় নিয়ে স্বস্তিবোধ করে না, তার একটা বড় কারণ সে অন্য উপপরিচয়ে জীবনধারণ করে থাকে। সে অমুকের ঘনিষ্ঠ, সে তমুকের বংশধর, সে অমুক পদবীভূক্ত কুলীন বামুন বা কায়েত, সে সাউথ পয়েন্ট বা ডন বস্কো বা প্রেসিডেন্সি বা সেইন্ট জ়েভিয়ার্সে পড়েছে (আমি দিল্লির এক বাঙালি অধ্যাপিকার সঙ্গে আলাপের সময় দেখেছিলাম যে তিনি এই জেনেই উল্লসিত যে তাঁর মত আমিও যাদবপুরে পড়েছি, তিনি যাদবপুরিয়ান বলে একটি কথাও ব্যবহার করলেন। তিনি জানেন না যে বাংলায় পুরিয়া শব্দটা একটা স্ল্যাং! এবং মজার ব্যাপার হল একজন স্বজাতীয়র সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি একটি বাংলা কথাও ব্যবহার করলেন না, সমস্ত কথা চালালেন ইংরেজিতে, যদিও আমি বাংলাতেই বলছিলাম), বা সে বিলেত-অ্যামেরিকার অমুক কলেজের প্রাক্তনী, সে অমুককে তার গডফাদার মেনেছে এবং সে তমুক গোষ্ঠীতে নাম লিখিয়েছে। কলকাতায় আমার পড়াশোনার সময় দেখেছি, কোনও না কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির নেকনজরে না পড়লে সেখানে অ্যাকাডেমিক্সে বা মিডিয়াতে ঢোকাই যায় না। বাংলায় এখনও জমিদারিপ্রথা চলছে, গোষ্ঠীপ্রথা চলছে। আমাদের কিংবদন্তিসম ব্যক্তিত্বরা সবাই এই জমিদারিপ্রথাকে লালন করেছেন, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। সিপিএম এসে এই জিনিসটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে আর কি। পুঁজিবাদের প্রয়াসই থাকে এরকম সামন্তধর্মী নেক্সাস বজায় রাখা, কারণ পুঁজি তো মানুষে মানুষে টাকা ছাড়া অন্য সম্পর্ক স্বীকার করে না, অথচ তাতে কাজ চালানো অসম্ভব, তাই পুরোনো সমাজের থেকে এই বদ সম্পর্কগুলো (পেট্রিয়ার্কি ও ফ্যামিলি সহ) সে ধার নেয়। এটা বিখ্যাত মার্ক্সিয় ঐতিহাসিক এরিক হবসবমের মত। আর বাংলায় এত গোষ্ঠীর, জমিদারের, সমাজপতির, মোড়লের ছড়াছড়ির কারণ কি, সে প্রসঙ্গে আমার মনে হয় আমাদের অতি-উর্বরা, বহুফসলা, সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা resourceful মাতৃভুমির জলহাওয়া এর জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী হতে পারে।

মার্ক্সিয় চিন্তায় ধর্ম নিয়ে সেই এঙ্গেলস থেকে আজকের টেরি ইগলটন পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে, আমি চাই হিন্দু বাঙালির ওপরে সেই চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে একটি সুসংহত কাজ হোক, যাতে অনেকগুলি বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা যাবে। আমরা, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বাসিন্দা যে জন্মসূত্রে হিন্দু বাঙালি সেটা লুকোছাপা করার চেষ্টা হাস্যকর, তাকে ট্যাবু বানিয়ে তোলা এবং তার উল্লেখ নিষিদ্ধ করা এবং তা নিয়ে এক ফ্রয়েডিয় অস্বস্তিতে ভোগা আমাদের শিক্ষিত বাম-লিবেরাল অংশটির এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর ফলে এক ভয়াবহ গ্যাপ তৈরি হয়েছে, বাকি বাঙালির সঙ্গে এই অংশটির। এরা বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না বা বাবা তারকনাথ জাতীয় বাংলা ছবি কেন রইরই করে চলে সেটা ভেবে অবাক হয়ে যান। দমদমে যখন বিজেপি জেতে, তখনও এই বুর্জোয়া লিবেরাল বামপন্থিরা অবাক হয়ে যান। সাধে কি আর নরেন্দ্রনাথ দত্তর পিতাঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, বড় হয়ে আর যা-ই হোস না কেন বাবা, অবাক হোস না।

আলোচনার এই অংশের শুরুতে ব্রিটিশ সমালোচক টেরি ইগলটনের যে বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছি, সেখানে ইগলটন ধর্মের সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে কিছু বলেননি, যদিও অন্যত্র এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। মানুষ সামাজিক সঙ্ঘবদ্ধ প্রাণী, অ্যা্রিস্টোটল বলেছিলেন political animal। একতাবদ্ধ হওয়ার একটি সুত্র চাই। আধুনিককালে যেকোনও পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট সমাজে সেই সূত্রটি যোগায় ভাষা ও সংস্কৃতি। ভাষা যে শুধু দুটো একটা কবিতা গল্প লেখার জন্য নয়, ভাষা যে আমাদের মস্তিষ্কের নিয়ামক, আমাদের চিন্তার নিয়ন্ত্রক, তা যে এমন এক বিশাল মহাবিশ্ব যার ওপারে যাওয়ার ক্ষমতা মানুষের কখনও হয়ই না, এগুলো বিংশ শতাব্দির সমস্ত দর্শন স্বীকার করেছে, Saussure থেকে Lacan সবাই তা মেনেছেন। অবশ্য যে সমাজে এনলাইমেন্ট ঘটেনি, সেখানে ধর্মই সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রধান মিডিয়াম হয়ে থেকে যায়, যেমন গোঁড়া মুসলিম দেশগুলি। এইজন্য ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গত প্রায় একশো বছর ধরে মানুষের মধ্যে এক কাল্পনিক কমিউনিটি (বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের কথায়)বানিয়ে তোলে। কাল্পনিক, কারন পাঠক, আপনি ও আমি এক যোগসূত্র কল্পনা করছি। মনে করছি, কোনও একটি কারণে আপনার ও আমার মধ্যে বেরাদরি স্থাপিত হয়েছে। সেটা আমাদের বিরাট মানবিক প্রাপ্তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু বাংলা ভাষা সংস্কৃতিকে এই হিন্দি ইংরেজির রাজত্বে রক্ষা করার জন্য নয়, তা শুধু গ্লোবালাইজ়েশনের যুগে মৃত্তিকা থেকে উঠে আসা প্রতিরোধ নয়, তা আমাদের মধ্যে এক কমিউনিটির জন্ম দেয়। তা অসংখ্য নিম্নবর্গীয় বাঙালির ক্ষমতায়ণের লক্ষ্যে এক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, তাই মার্ক্সিয় চিন্তায় অপরিহার্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ব্যক্তি বাঙালির alienation ঘোচায়। তা আমাদের ইতিহাসের শিহরণ, তা আমাদের পরিচয়ের উল্লাস। এ মাতৃদুগ্ধের মত, তাই কোনও বিকল্প হয় না।

এই লেখাটি এখানেই শেষ হচ্ছে, তবে আলোচনা শেষ নয়। সবে শুরু।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ

তিন

পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনায় যে অবধারিত প্রশ্নটি উঠবে, সেটি হল খামখা এই বিষয়ে সময় নষ্ট করা কেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই, আমাদের এক বন্ধু সম্প্রতি ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন। আমাদের শিক্ষাবিস্তার, আমাদের রেনেসাঁস, আমাদের বামপন্থা (ভালগার বা আঁতেল) আমাদের শিখিয়েছে আন্তর্জাতিক হতে। বু্দ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন সাংস্কৃতিকভাবে বাংলা ইউরোপের একটি অংশ। অতিশয়োক্তি, কিন্তু এ থেকে আমাদের পশ্চিমমুখি মনন ধরা পড়ে (এবং সেই পশ্চিমমুখি চিন্তন ও ভাবান্দোলনের সুফল কেউ অস্বীকার করে না)। অনেকটা সেকারণে উচ্চবর্নের বাঙালি হিন্দু নিজের আইডেন্টিটি নিয়ে কি করবে, খাবে না মাথায় দেবে, ঠিক নিশ্চিত নয়। এবং সাধারণভাবে সে বাংলায় প্রচুর ইংরেজি শব্দের মিশেলে স্বস্তিবোধ করে। এ জন্য আমাদের কিছু সমস্যাও হয়। বাংলাদেশের কেউ কেউ আমাদের বাংরেজি দেখে ক্ষেপে গিয়ে ভাবেন চালবাজি করছি, আসলে যে এভাবেই আমাদের শিক্ষিতদের সিংহভাগ কথা বলেন, তা তারা জানেন না।

প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বাংলাদেশি বাঙালিদের জাতীয়তাবাদ আমাদের বিবেচ্য নয়। ইতিহাসের ঘটনাবহুল নিয়মে উচ্চবর্নের বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান এলিট বাংলাদেশকে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। পূর্ব অংশটি হয় পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম অংশটি পরিচয় পায় পশ্চিমবঙ্গ বলে। এরপর পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামটা দখল করে নেয়, এবং এই দেশটির ভিত্তিই হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ। পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারটা কিরকম হয়েছে, দেখা যাক। এবং সলতে পাকাতে হবে আবার।

বাঙালি হিন্দু উচ্চবর্ণ। বৌদ্ধধর্মকে, এবং বাঙালির স্বকীয়তাকে নষ্ট করে ক্ষমতায় আসা সেনবংশের ধামাধারি। উত্তরভারত থেকে আসা, অন্তত কিংবদন্তি সেই উৎসকেই উদযাপন করে। সঙ্গে করে আনা সনাতনধর্মের যাবতীয় বর্ণভেদ। যেহেতু ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ বাঙালিই ছিলেন না, প্রাথমিকভাবে বাংলার প্রতি, বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির প্রতি তাদের অবজ্ঞা ও দেবভাষার প্রতি তাদের ভক্তি থাকাই স্বাভাবিক। বাংলা বহুদিন আর্যাবর্ত্মের কাছে ব্রাত্য ছিল। এখানে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। বৌধায়ন বলেছিলেন বাংলায় অসুরভাষা বলা হয়। এ থেকে অনেকে অনুমান করেন, বাংলায় দীর্ঘনাসা নর্ডিক আর্যরা আসেননি, যেমনটা উত্তরভারতে হয়েছিল। হয়ত এখানে গোলমুণ্ড অ্যালপাইন আর্যরা এসেছিলেন, যারা বেদ মানতেন না (সুর বনাম অসুরের যে দ্বন্দ্ব পুরাণে দেখি)। এমনও হতে পারে আর্যরা পুর্বভূমি স্মৃতি সঙ্গে করে আনেন, এবং অন্যান্য অবৈদিক আর্যদের সঙ্গে তাদের যে দীর্ঘ লড়াই, যার ফলশ্রুতিতে সম্ভবত তারা পূর্ব ইউরোপ/এশিয়া মাইনর ছাড়েন ( একটা আকর্ষণীয় বিষয় হল, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় অনেকগুলি নদীর নামে -দনু রুট পাওয়া যায়, দানিয়ুব, দনীপার, দন, দনীয়েস্টার। খুব সম্ভবত দনুজ-দানব নামক অবৈদিক আর্য ট্রাইবটির কাছে পরাস্ত হয়ে বৈদিক আর্যরা এদিকপানে আসেন), তা তাদের ভবিষ্যৎ শত্রুদের নামকরণেও ছাপ ফেলে। তাই ভারতে এসে হয়ত তারা দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতিগুলিকে অসুর, দানব রাক্ষস ইত্যাদি মধুর সম্বোধনে ভূষিত করেন। কাজেই বাংলার ভাষাকে ঠিক কেন অসুরভাষা বলা হয়েছিল, জোর দিয়ে বলা যায় না। এটা ঠিক যে বাংলা ও গুজরাটের উচ্চবর্ণের মধ্যে কিছু শারীরিক সাদৃশ্য আছে, এবং উভয় জায়গার ভাষাতে ও-কারের বাহুল্য। অনেক ঐতিহাসিক বলেন এই দুই প্রদেশে প্রথম যে আর্যরা আসেন, তারা অবৈদিক অ্যালপাইন। ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ মনে করেন যে বাঙালি উচ্চবর্নের মধ্যে বৈদ্য নামক বর্ণটি ওই অ্যালপাইন আর্যদের অবদান। তবে ব্যপারটা কনজেকচার। অন্তত গুজরাটিদের মধ্যে বৈদ্য নামক কোনও বর্ন এটি গ্রাহ্য হত, তবে আমার গুজরাটি বন্ধুদের জিগ্যেস করে জেনেছি যে এমন কোনও বর্ন সেখানে নেই। বরং এটা বেশি যুক্তিগ্রাহ্য যে বৈদ্যরা ছিলেন বৌদ্ধ শ্রবণ, স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারির কাজ করতেন, এবং সনাতনধর্মের পুনর্জাগরণে এরা তার অংশীদার হতে রাজি হয়ে যান, ও ব্রাহ্মণ কায়স্থের পরেই জায়গা পান (বর্তমানে এরা ব্রাহ্মণের পরেই আছেন, এমনটা কিন্তু চিরকাল ছিল না)।

অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র সুহ্ম, এই পাঁচটি পূর্বভারতীয় জনজাতির কথা পুরাণ বলছে। নামগুলি অস্ট্রিক, ঐতিহাসিকরা বলছেন। পুরাণ এই নামগুলিকে দ্রাবিড় মহাসম্রাট বলির উত্তরাধিকারিদের সঙ্গে যুক্ত করে। অর্থাৎ আমাদের উৎস অনার্য। অ্যালপাইন আর্যরা যদি এসেও থাকেন, বৈদিক নর্ডিক আর্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায় ছিল এমন ভাবা ভুল হবে না (তাই দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা না গড়ে উঠলে সেটাই হবে আশ্চর্য ব্যাপার), তাই বাংলা এবং পূর্বভারতে যে শক্তিসমূহ মাথা তোলেন, যাদের বীরত্বের কথা শুনে আলেকজ়ান্ডার ভারত-অভিযান পরিত্যাগ করবেন, যারা বেদবিরোধী, নিরীশ্বর, প্রায় প্রোটো-কমিউনিস্টিক বৌদ্ধধর্মকে বরণ করে নেবেন ১৬০০ বছরের জন্য (ভৌগলিকভাবে যে অঞ্চলকে আজ বাংলা বলি, সেখানে সবথেকে বেশি সময় থেকেছে বৌদ্ধধর্ম। সনাতন ধর্ম ও ইসলাম মেরেকেটে হাজার বছর পার করেছে কি করেনি), তারা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বিপুল শক্তিশালি একটি polity ছিলেন। আজ শিডিউল্ড কাস্ট হিসেবে গণ্য হওয়া পৌণ্ড্ররা আমাদের শাসক ছিলেন, আমাদের প্রতিরোধের ঐতিহ্য ছিল, আগে ডোম বাগে ডোম ঘোড়াডোম সাজে (আগডুম বাগডুম বলে যে ছড়াটিকে আমরা চিনি, এবং যা আজ আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাছে আগডুম বাগডুম, কোনও কিছুর মানে না বুঝলে বা gibberish মনে হলে আমরা বলি আগডুম বাগডুম) নামক প্রবাদের ডোম বা চাঁড়ালরা আজ নমশূদ্র বলে পরিচিত, তারা আমাদের বীর পূর্বজ ছিলেন। আমি এই লেখায় কিছুটা বাষ্পনয়নে দুহাত তুলে আমার প্রাক্তন সেনাপতি ও সম্রাটদের জয়ধ্বনি দিচ্ছি ও অভিবাদন জানাচ্ছি। গ্রহণ করুন। আমি আপনাদেরই উৎস বলে মানি, আমি আপনাদের আনুগত্য স্বীকার করি। আমি মনে করি আপনারাই আমার জাতিকে গড়ে তুলেছিলেন। সেনরা এসে যখন বর্ণভিত্তিক সনাতনী ব্যবস্থা চালু করলেন, তখন নমশূদ্রদের সবথেকে নিম্নস্তরে নামানো হয়েছিল। ব্যাপারটা আশ্চর্যের, নীহাররঞ্জন রায় বলছেন। তবে এও আন্দাজ করেছেন যে এর মূলে কোনও গূঢ় ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে আছে। আমার ব্যাখ্যা ওপরে দিলাম। এইসময় একইভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সোনার বেনেদেরও কাস্ট হায়ারার্কিতে নিচে নামানো হয়।

চর্যায় যে বাংলাভাষার জয়যাত্রা, সেন আমলে তা থমকে যাবে, এবং সংস্কৃতচর্চা শুরু হবে। এবং বাঙালি ব্রাহ্মণ কায়স্থরা তখন বাংলায় সনাতনধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটাবেন, সমস্ত বাঙালিসমাজকে জাতপাতের নিগড়ে বাঁধবেন।। এরা ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার, ক্ষমতার এজেন্ট হওয়ার বিদ্যায় নিজেদের ভালমত গড়েপিটে নেবেন। শুরু হবে হাজার বছরের জাতপাতভিত্তিক বাঙালি বর্ণহিন্দু সমাজ, যার সমাজপতিদের মুখ পশ্চিমে ফেরানো, যাদের নিজস্ব মাতৃভাষা থাকবে না, ক্ষমতার ভাষাই হবে তাদের ভাষা। এরপর ইসলাম রাজধর্ম হবে, এবং পারসীক হবে রাজভাষা। অতি দক্ষতায় বাঙালি উচ্চবর্ণ, বিশেষ করে কায়স্থরা পারসীক শিখে নেবেন, এবং আবার ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি চলে আসবেন, ক্ষমতার দালাল হবেন। যদিও এই সময়েই একটা দেশজ, লোকায়ত সংস্কৃতির পোষণের চেষ্টা চলবে, মূলত সনাতনধর্মকে বাঁচানোর তাগিদে।
চারটি বেদে শূদ্র ও নারীদের অনধিকার ছিল। পঞ্চমবেদ বলে কথিত মহাভারত ছিল সেযুগের জনপ্রিয়তম কাব্য, মহাভারত যে শুরু হয়েছিল ব্যালাড হিসেবে তার প্রচুর প্রমাণ আছে। তা গীত হিসেবে ছিল বিনোদনের এক অপূর্ব মাধ্যম (একই কথা রামায়ণ সম্পর্কেও বলা চলে)। তাই মহাভারতকে শূদ্রের জন্য, নারীর জন্য নিষিদ্ধ করা যায়নি, স্রেফ অসম্ভব ছিল বলে। এই জনপ্রিয় গাথার নায়ক কৃষ্ণকে বহু আগেই বিষ্ণুর অবতার বলে সনাতনধর্ম আত্মীকরণ করেছিল, যদিও মহাভারত আর্য অনার্যের মিশ্রণের এক চমৎকার উদাহরণ এবং চরিত্রগুলির সকলেরই প্রায় জন্ম সম্বন্ধীয় গোলযোগ আছে, কেউই খাঁটি আর্য নন। কৃষ্ণ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ (ব্যাসদেব) জন্মগতভাবেই অনার্য, একজন যাদব অন্যজন দাসবংশজাত।
এখানে কথা প্রসঙ্গে বলি, সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্বেও, আর্যাবর্ত্ম ও সনাতন ধর্ম আমাদের আংশিক অতীত, যেভাবে প্রাচীন গ্রীস ও রোম ইউরোপের উৎস। একে কোনও বালখিল্য প্রগতিবাদিতায় যেন নস্যাৎ না করা হয়। ইতিহাস অস্বীকার করলে শুধু পুঁজির সুবিধা, শাসকের সুবিধা, এমনকি হিন্দু মৌলবাদিরও সুবিধা, যেন ভুলে না যাই।

সে যাই হোক, এই দুই মহাকাব্যের নায়ককে ভগবান বানিয়ে আর্যাবর্ত্মে (বাংলাকে এই সময় থেকে আর্যাবর্ত্মের উপনিবেশ হিসেবেই ধরতে হবে) এক লোকায়ত ধর্ম প্রচলনের চেষ্টা মধ্যযুগে দেখা যায়। বেদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থগুলি ছিল উচ্চবর্ণের এক্সক্লুসিভ সম্পত্তি, কাজেই তা এইসময় থেকে মোটামুটি বেকার হয়ে পড়ে। এইসময় শুরু হয় ভক্তি আন্দোলন, বাংলায় যা জাতপাতের সমস্যা কিছুটা মেটাবে, এবং polityর গণতন্ত্রীকরণ ঘটানোর দিকে এক নিশ্চিত পদক্ষেপ নেবে। বৌদ্ধধর্মের অবলুপ্তিতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা যেন বাংলার বৈষ্ণব আন্দোলন সারাতে চেয়েছিল, এবং চৈতন্যকে মনে হয় মধ্যযুগের বুদ্ধ। জ্ঞানের জায়গা নিয়েছিল ভক্তি, কিন্তু লোকায়তজনের ক্ষমতায়ন ছিল উভয়েরই ধ্রুব লক্ষ্য।
বাংলার অন্যান্য গাথাগুলি এসময় লিপিবদ্ধ হতে শুরু করে মঙ্গলকাব্য হিসেবে, লোকায়ত ও ব্রাত্য দেবদেবীরা চিরকালই অন্ত্যজদের জীবনের মূলের কাছাকাছি ছুঁয়ে থাকেন, এবার তারা সনাতনধর্মের প্যান্থিয়নে চলে আসবেন। এই সময় বাংলার সনাতনধর্ম এক নবরূপ ধারন করে, এবং একে কোনওমতেই সেই কিংবদন্তির আদিশূরের বর্ণভেদমূলক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বললে চলবে না। বৌদ্ধধর্মের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য এই হিন্দুধর্মে মিশে থাকবে, যেভাবে ব্রিটিশ সমালোচক রেমন্ড উইলিয়ামস দেখিয়েছিলেন residual cultural forms গুলি dominant cultural forms এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে। আজ বাংলায় যে হিন্দুধর্ম আমরা জানি, বোষ্টম-বাউল-সহজিয়া-শাক্ত মিশ্রিত এই ধর্মের লোকায়ত চেহারাটি কিন্তু সনাতন ধর্ম আদপেই নয়।

কিন্তু সমাজ শাসন করছেন যারা, তারা ক্ষমতাকেন্দ্রেই থাকবেন। সৈয়দ মুজতবা আলি চমৎকার দেখিয়েছিলেন যে বাংলা ভাষা পারসীক সিনট্যাক্স অনুযায়ী লিখিত হয়ে আসছে, সংস্কৃত সিনট্যাক্স অনুযায়ী নয়। কায়স্থরাই সেযুগে পেশাদার লিপিকার ছিলেন, যাকে বলে scribe। ব্রাহ্মণরাও মুসলিম শাসকদের চাকুরিগ্রহণে খুব পিছিয়ে ছিলেন না, তবে কায়স্থদের মত এত উন্নতি করে উঠতে পারেননি। কায়স্থরা পারসীক শিখতেন প্রায় নিজের মাতৃভাষার মত, আজ যেভাবে বাঙালি বর্নহিন্দু ইংরেজি শেখে এবং বলে প্রায় মাতৃভাষার মত (এবং এও বলা হয় যে বঙ্কিমের সময় থেকেই বাংলা গদ্য ইংরেজি সিনট্যাক্সের অনুসারী হয়ে ওঠে)। আমরা comprador, আমাদের ভাষাতেও তার ছাপ রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ

দুই

একবার কলকাতায় গিয়েছি একটা কাজে। তখন আমদের বসবাস দিল্লিতেই। হাতে পয়সাকড়ি যা আছে, তাতে দু-তিনদিনের বেশি চলবে না। ক্রেডিট কার্ডের কোনও গল্প নেই। তখনও আমি দিল্লিতে অধ্যাপনার চাকরি পাইনি, ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছি। সবাই করুণার হাসি হেসে বলছেন, চেনাজানা ছাড়া কি আর জেনেরাল ক্যাটিগরিতে চাকরি হয়! স্ত্রী ফোনে বলছেন দিল্লিতে ফিরে যেতে, কাজ মাথায় থাকুক। কিন্তু আমার দুটো একটা বিষয়ে বেশ বাঙালপনা আছে। যদিও অর্ধাঙ্গিনী বলেন যে আমি ঘটিফায়েড বাঙাল। সেটা খাদ্যাভাসে।

আমি রবীন্দ্র সদনের সিঁড়ির এককোনায় বসে ছিলাম। সঙ্গে কোনও বন্ধু নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই চত্বরটা খুব প্রিয় ছিল। সবদিনের মতই সেদিন কিছু একটা অনুষ্ঠান চলছে। কিছু বিশেষ অনুষ্ঠান, কারণ একের পর এক ধুতি পাঞ্জাবি ও জমকালো শাড়ি পরিহিত অভিজাত পঞ্চাশোর্ধ বাঙালি নারী-পুরুষ এসে গাড়ি থেকে নামছিলেন, এবং উদ্যোক্তারা সমাদর করে তাদের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। কোনও অল্পবয়সী অভ্যাগতকে দেখিনি। আমার মনে হচ্ছিল, যে এটাই খুব সম্ভবত বাঙালিয়ানা। এক্সক্লুসিভ, নাক-উঁচু, উচ্চ-ভ্রূ, মেনোপজ়াল, এবং সংস্কৃতিপরায়ণ। এর সঙ্গে সাধারণ বাঙালির, জীবনযুদ্ধে নামা বাঙালির, যুবা-বাঙালির যোগ কোথায়?

বাঙালি বললে বহুদিন ধরে শুধু বাঙালি হিন্দু বোঝানো হয়েছে, আজও পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্বল্পশিক্ষিত মানুষ এইভাবে বাঙালি শব্দটা ব্যবহার করেন। আমরা বাঙালি এবং ওরা মুসলমান। আর বাঙালি হিন্দু বললে অবশ্যই বাঙালি ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ। আমাদের দেশভাগ হবে না তো কাদের হবে!

বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি? সাধারণ বাঙালির সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কি জ্যাঠা জাতীয়তাবাদ বলে যায়, অর্থাৎ এ শুধু বিভিন্ন ক্ষেত্রের জ্যেষ্ঠদের একচেটিয়া? স্টার আনন্দের প্যানেল আলোচনায় যারা স্টুডিও আলো করে বসে থাকেন, তাঁরা কি আমাদের জাতির অভিভাবক? বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানে কি অবাঙালি বা বিদেশিরা কোনও বাঙালিকে সাফল্যের স্বীকৃতি দিলে তাই নিয়ে খবরের কাগজ ও নিউজ় চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ়? একজন লিখেছিলেন, বাঙালির শুধু সৌরভ গাঙ্গুলি ও অমর্ত্য সেন, দুটি বই ল্যাজ মোর নাই রে! যেমন কিছুদিন আগে আনন্দবাজারে খবর হল যে বাঙালি বিজ্ঞানি আমেরিকার জন্য যুদ্ধবিমান বানিয়েছেন। যেমন সেরা বাঙালির পুরস্কার দেওয়ার জন্য আ.বা.প. সিঙ্গাপুর, দিল্লি, বম্বে ও অ্যামেরিকা থেকে বাঙালি খুঁজে আনে। প্রশ্ন হল, এই হ্যাংলামি ও আদেখলেপনা কি বাঙালি জাতীয়তাবাদ? বিদেশ-বিভুঁইয়ে দু-একটি বাঙালির সাফল্যে ছাগলের তিননম্বর ছানার মত লম্ফ দেওয়া কি বাঙালি জাতীয়তাবাদ? এবং সর্বোপরি, এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি কেন হল, যে বাঙালির জীবনে বামফ্রন্ট হল ভিত্তি আর আনন্দবাজার হল ভবিষ্যৎ?

হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি শাসিত হচ্ছে comprador শ্রেণির দ্বারা। বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তির পরে যে দুটি ধর্ম আমাদের গ্রাস করেছে, সনাতন ধর্ম ও ইসলাম, দুটিই পশ্চিম থেকে আগত। বৌদ্ধধর্ম আমাদের মননের খুব কাছাকাছি ছিল, ভৌগলিক দিক থেকেও সেই নৈকট্য খুব প্রকট, কারণ এটি ছিল পূর্বভারতের ধর্ম। সনাতন ধর্মের জাতপাত আমাদের কুৎসিত অভিশাপ। আর পূর্ববঙ্গে প্রচারিত ইসলামের গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, ভিন ধর্মের প্রতি নোংরা বিদ্বেষ এবং ভিনধর্মীকে নিকেশ করে পূণ্যার্জন এসবের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল।
আমাদের সমাজ যাঁরা শাসন করছেন, গত হাজার বছর ধরে করে আসছেন, তাঁরা যথাক্রমে সনাতন ধর্ম ও ইসলামের অনুমোদিত দালাল শ্রেণি। এটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান দুর্বলতা। এই সমস্যা, যেমন ধরুন, দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের হয়নি। কেন হয়নি সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।

বিষয়টা অবশ্য এমন একদেশদর্শী নয়। বাঙালি উচ্চবর্ণ সবসময় দালালি করেননি। ভক্তি আন্দোলন এই সনাতন ধর্মী নিপীড়নকে কিছুটা স্তিমিত করেছিল। আমি চৈতন্যের কথা বলছি। আচারভ্রষ্ট, এই অভিযোগ এখানকার উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে বহুবার উঠেছে। বাঙালি ব্রাহ্মণকে উত্তরভারত ঠিক ব্রাহ্মণ বলে মানেও নি কখনও। তার কারণ অনেকগুলি। আমাদের উচ্চারণ, খাদ্যাভ্যাস, রক্তে প্রবল ভেজাল (বস্তুত বাঙালি উচ্চবর্ণের অনেকের গায়ের রঙ ঘোর কালো, ওদিকে বর্ণ কথাটার মূল অর্থই ছিল গাত্রবর্ণ। বাঙালি উচ্চবর্ণ নৃবিদ্যা অনুসারে অস্ট্রিক, মোঙ্গল, এবং দ্রাবিড় রক্তের অনেক বেশি কাছাকাছি, সেটা আমরা যারা উত্তরভারতে থাকি, ভালোরকম বুঝি)। আর সীমিতভাবে হিন্দু উচ্চবর্নের মধ্যে একটি রেনেসাঁস, রিফর্মেশন ও এনলাইটেনমেন্ট হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দিতে, সেটা নস্যাৎ করা উচিত নয়।

ইসলামের ইতিহাস আমি খুব বেশি জানি না, তবে লালন ফকির আছেন। যদিও তিনি আসলে হিন্দু ছিলেন, এবং সনাতন ধর্মের ছুঁৎমার্গের সমস্যায় পড়ে কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তা আমাদের জানা। বাঙালি মুসলমানরা অধিকাংশই ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ বা হিন্দু, এবং এই ধর্মান্তরকরণ তরবারির জোরে কিছুটা হয়েছে এটা সত্যি। ইসলামি শাসকরা ছ'শো বছর বাংলার অধিকারি ছিলেন এবং অধুনা বাংলাদেশ (যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম) ইসলামি মৌলবাদিদের খানিকটা দখলে। কাজেই এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ধর্মান্তরকরণ মূলত হয়েছে সনাতনধর্মের জাতপাতের সমস্যায়। সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গে ইসলাম এসেছিল সাম্যের বার্তা নিয়ে, নাবিকদের মাধ্যমে, আর পশ্চিমবঙ্গে তা ছিল পাঠান-মোঘল শাসকের রক্তচক্ষু। তাই এমন আশ্চর্য কাণ্ড দেখতে পাওয়া যায়। বাকি ভারতে ইসলাম ছড়িয়েছে একভাবে, বাংলায় অন্যভাবে। ইসলাম ভারতের পশ্চিমে থাকল, যা তার সাম্রাজ্য বিস্তারের itinerary তেই পড়ে। বাংলায় এসে সেটি পালটে গেল। পশ্চিম নয়, পূর্ব ইসলামে আস্থা জানাল। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম সেই সাম্যপরায়ণ প্রাক্তন বৌদ্ধদের খুব শিগগিরি গ্রাস করে নিয়ে এক মনোলিথিক ধাঁচায় পুরে দিতে দেরি করবেনা।

বাঙালি হিন্দু সমাজের দুটি প্রধান উচ্চবর্ণ, ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ, দুটিই এসেছে উত্তরভারত থেকে। কিংবদন্তি, রাজা আদিশূর পাঁচটি ব্রাহ্মণ ও পাঁচটি কায়স্থ আনিয়েছিলেন। আহা, সেই দত্ত কারও ভৃত্য নয় গল্পটি জেনে দত্তদের প্রতি আমার বেশ পক্ষপাত জন্মে যায়। যদিও অনেক বাঙালি আজও কায়স্থরা যে উত্তরভারতীয় তা ঠিক জানেন না। অমিতাভ বচ্চন একজন কায়স্থ। ওড়িশাতেও কায়স্থরা একটি প্রধান, আধিপত্যময় জাত এবং সেখানে এরা করণ বলে পরিচিত। পট্টনায়করা এই জাতের অন্তর্গত। এরা সিভিল সার্ভেন্ট ও কেরাণির কাজ করতেন, কাজেই সরকারের কাজে অপরিহার্য। বাঙালি বৈদ্যরা একটু অন্যরকম কেস, এ বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু লিখতে চেষ্টা করছি, তাই এখন আর কিছু লিখলাম না। বাঙালি নিম্নবর্ণের মধ্যে নমশূদ্ররা একটি ভীষণ আকর্ষণীয় ইতিহাস বহন করেন, এবং সে ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী ও কিঞ্চিত পড়াশোনা করছি, এবং তাঁদের বিষয়ে একটি লেখায় হাত দিতে চাই, তাই ও ব্যাপারেও আর কিছু লিখলাম না।

একটা বড় অংশের নিম্নবর্গীয় বাঙালিরা ইসলাম গ্রহণ করায়, উচ্চবর্নের বিরুদ্ধে, সনাতন ধর্মীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে যেভাবে দ্রাবিড় আন্দোলন গড়ে উঠতে পেরেছিল, সে সম্ভাবনা বাংলায় দেখা দেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাংলায় এস সি ফেডারেশন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, এর নেতারা মুসলিম লিগের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থন করেছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্বাধীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীও হন। এরপরের ইতিহাস অত্যন্ত ট্র্যাজিক। তিনি ১৯৫০ সালে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে আসেন, এবং কলকাতার ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের একটি বস্তিতে ৫৬ সালে মারা যান। বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্নের পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থনের জন্য দুয়েকটি হিন্দুপ্রধান জেলা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়, কাজেই উচ্চবর্গীয় নেতারা যোগেন্দ্রকে ক্ষমা করবেন না, জানা কথা। দেশভাগের ট্র্যাজেডি আসলে বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্ণের ট্র্যাজেডি। এবং সেই যে এস সি ফেডারেশনের শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যায়, আজ পর্যন্ত নিম্নবর্ণরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে (বাংলাদেশের কথা ছেড়েই দিলাম, সেখানে হিন্দুরা ক্রমশ দেশত্যাগ করছে) ব্রাত্য হয়েই আছেন, বাকি ভারতে যেখানে দলিতদের (অন্তত তাদের একটা অংশের) ক্ষমতায়ন হয়েছে। বাঙালি দলিত পূর্বে অর্ধচন্দ্র খেয়েছেন, আর পশ্চিমে মরিচঝাঁপি পেয়েছেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান সমস্যা এই। এদিকে ভদ্রলোক শাসিত, ওদিকে মুসলিম এলিট শাসিত (একজন ঐতিহাসিক লিখেছিলেন, এদিকে ব্রাবৈকা, ওদিকে শেসৈকা। অর্থাৎ এদিকে ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ, ওদিকে শেখ সৈয়দ কাজি)। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি আন্দোলন, যেটি আসলে কাঁঠালের আমসত্ব থেকে গেছে, এই ভদ্রলোক ডমিনেশন আর স্তালিনবাদি ভালগার মার্ক্সবাদের যুগলবন্দীতে (একে রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর) একের পর এক বিপর্যয় ঘটিয়ে এখন খুব সঙ্গত কারণেই গঙ্গাপ্রাপ্তির অপেক্ষায়।

Monday, September 6, 2010

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ



"Nationalism", remarks an African character in Raymond Williams's novel Second Generation (London, 1964), "is in this sense like class. To have it, and to feel it, is the only way to end it. If you fail to claim it, or give it up too soon, you will merely be cheated, by other classes nd other nations." Nationalism, like class, would thus seem to involve an impossible irony. It is sometimes forgotten that social class, for Karl Marx at least, is itself a form of alienation, canceling the particularity of an individual life into collective anonymity. Where Marx differs from the commonplace liberal view of such matters is in his belief that to undo this alienation you had to go, not around class, but somehow all the way through it and out the other side. To wish class or nation away, to seek to live sheer irreducible difference now in the manner of some contemporary post-structuralist theory, is to play straight into the hands of the oppressor.

Terry Eagleton 'Nationalism: Irony and Commitment' (from 'Nationalism, Colonialism and Literature')



এক


যে প্রধানতম কারণগুলি পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিদের পরিচয়-সঙ্কট সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে ভালগার
মার্ক্সবাদি চিন্তাধারা অন্যতম, আর চিত্তাকর্ষকভাবে এর সঙ্গে সুন্দর তান ধরেছে বুর্জোয়া উদারনীতি। সংক্ষেপে বললে একদিক থেকে বামপন্থি, অন্যদিক থেকে দক্ষিণপন্থি, এই দুই সাঁড়াশি আক্রমণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বহুদিন থেকেই পশ্চিমবঙ্গে কোনঠাসা। কিন্তু সমস্যা সেখানেই শেষ হয় না, এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোনঠাসা হওয়ার কারণ অনেকগুলি।

একসময় হাওড়া স্টেশনে দেওয়াললেখন দেখা গিয়েছিল, আশি শতাংশ বাঙালির চাকরি চাই। আমরা বাঙালি (পশ্চিমবঙ্গে এই নামে একটি অতিক্ষুদ্র, তীব্র দক্ষিণপন্থি, আনন্দমার্গি প্রভাবিত মৌলবাদি সংগঠন আছে)। কিছুদিন পরে দেখা গেল, কোনও রসিকজন নিচে ছোট্ট করে লিখে দিয়েছেন, বাকি কুড়ি শতাংশ কি হাত মারিবে? আমরাও বাঙালি। এরপর বিষম খেয়ে আমরা বাঙালি অবশ্য পুরো একশো শতাংশ বাঙালির চাকরি দাবি করা শুরু করে দেয়! এ থেকে আমাদের আরেকটি ট্র্যাজেডি সামনে আসে। চাকুরিপ্রিয়, বঙ্কিম বলেছিলেন।

বাঙালিয়ানার আরও একটি সমস্যা এখানে দৃশ্যমান। উচ্চবর্গ এই ডিসকোর্সকে কখনও প্রাধান্য দেননি, ফলে বাঙালিয়ানা কি, সেটা নিয়ে কি করব, আদৌ সেটা খায় না মাথায় দেয় তা নিয়ে শিক্ষিত মহলে তীব্র বিভ্রান্তি ছিল। এবং যে অল্পশিক্ষিত মানুষেরা সম্পূর্ণ দিশাহীনভাবে খুঁজে যাচ্ছিলেন নিজের পরিচয়, তাকে লালন ও রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা বিদ্রূপের পাত্র হিসেবে পরিচিত হন।

আমার জন্মের পর বাঙালিয়ানা শব্দটি ব্যবহৃত হতেই খুব কম দেখেছি। ১৯৯৯ সাল নাগাদ প্রথম এই বাঙালিয়ানা শব্দটি হঠাৎ আজকাল বলে একটি বাংলা কাগজ ব্যবহার করা শুরু করে। আজকাল বরাবরই সিপিএম এর ভেতরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গোষ্ঠীর মুখপত্র ছিল, কিন্তু নব্বই এর দশকে অনেক সিপিএম বিরোধী, গণতন্ত্রী ও বিকল্প বামপন্থায় বিশ্বাসি মানুষ এই কাগজটি পড়তেন। তখনও আজকাল এমন সিপিএম এর ধামাধরা হয়ে যায়নি। অনেকে আজ আর বিশ্বাস করবেন না, একসময় আজকাল মমতা ব্যানার্জিকে অনেক বেশি কভারেজ দিত এবং গণতন্ত্র রক্ষায় তার লড়াইয়ের সমর্থক ছিল। কবীর সুমনের (তখন সুমন চট্টোপাধ্যায়) আত্মজীবনী 'হয়ে ওঠা গান' প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয়া আজকালে।

সেসময় কলকাতার ক্রিকেট জ়ার জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন জ্যোতি বসু ও সুভাষ চক্রবর্তির ঘনিষ্ঠ। এদিকে বুদ্ধদেব গোষ্ঠী তখন থেকেই তাকে সরাতে চাইছিল (এই সঙ্ঘর্ষ ২০০৬-৭ এ আবার মাথাচাড়া দেবে)। ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির ঠিক আগে আজকাল সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত কিছু লেখা লিখতে শুরু করেন, কলকাতায় বাঙালির অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদাত্ত ডাক দিয়ে (মূল উদ্দেশ্য ছিল মাড়োয়ারি ডালমিয়াকে সরানো)। বাঙালিয়ানা বলে একটা শব্দ বহুল ব্যবহৃত হতে শুরু করে। মূলত আজকালের উদ্যোগে নবজাগরণ নামে একটা সংগঠন শুরু হয়, তাতে সুনীল গাঙ্গুলিও জড়িত ছিলেন। সুনীল সেই সময় আনন্দবাজার কাগজে একটার পর একটা উত্তর-সম্পাদকীয় লেখেন, একটি প্রধান দাবি ছিল কলকাতায় সমস্ত সাইনবোর্ডে বাংলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সুনীল কানাডার ফরাসীভাষি কুইবেক প্রদেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন যে সেখানে যেমন ফরাসি ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য ভাষা পুলিস তৈরি হয়েছে, কলকাতায় তাই করতে হবে (সুনীলকে এ জন্য করসেবক এবং শিবসেনা বলে গাল দিয়েছিলেন একজন মাইনর লেখিকা অনিতা অগ্নিহোত্রি, যিনি আনন্দবাজারের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন, এখনও আছেন কিনা জানিনা)। তা যদিও হয়নি, কিন্তু এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে তারা কিছু অভিযান করেন, কলকাতা পুরসভা এরপরে এই মর্মে আইন তৈরি করেন। আজ ধর্মতলা অঞ্চলে সমস্ত দোকানের সাইনবোর্ডে আপনি বাংলা দেখতে পাবেন, ছোট করে এককোনায় লেখা থাকে অবশ্য, তবু তো থাকে। এখনকার প্রজন্মের জানা উচিত যে আমাদের ছোটবেলায় আমরা কিন্তু কলকাতার কেন্দ্রস্থলে বাংলা লেখা খুঁজেই পেতাম না। এই সময় আরো একটি দাবি সামনে আসেঃ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত স্কুলে (যে বোর্ডেরই হোক না কেন) বাংলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেটা এখনও হয়নি।

এই সময়েই ক্যালকাটা নাম পালটে দিয়ে করা হয় কলকাতা। বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাব নেওয়া হয়, ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে রাজ্যের নাম হবে বাংলা। যদিও তা আর কেন্দ্রের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় নি (ভারতে রাজ্যের নাম পালটাতে গেলে কেন্দ্রের অনুমোদন লাগে), এবং সেটি এখন হিমঘরে চলে গেছে। কিন্তু ইতিহাস পালটানো যায় না। বাঙালি বিধায়করা চেয়েছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা প্রস্তাব পাশ করেছিল, এটা ইতিহাসে থেকে যাবে, এবং আমাদের এ ব্যাখ্যাও খুঁজতে হবে যে কেন শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেল।

বাংলায় লেখা গ্রিটিংস কার্ড এই সময়ে বাজারে আসতে শুরু করে। বাংলা ব্যান্ডের জয়যাত্রা এইসময় শুরু হয়। অল্পবয়সিরা বাংলা গান শুনতে শুরু করেছিলেন নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎদের সময় থেকেই, নব্বই দশকের প্রথমভাগে। সুমনকে নিয়ে একশ্রেণির গুরুঠাকুর-গুরুজনেরা এমন গম্ভীর আচরণ দেখাতে থাকেন, এবং মাধ্যমিক পরীক্ষার টেস্টে (হিন্দু স্কুলে) সুমনের গান (সূর্য বলল ইস) ভাবসম্প্রসারণে চলে আসে, ফলে আমরা যারা কিশোরবয়সী ছিলাম, কিছুটা ভেবড়ে যাই। সেইবয়সে সুমনের প্রতি কিছুটা বীতরাগ চলে আসে, কারন মনে হচ্ছিল সুমন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। এত ভারি কথা নিশ্চয়ই মনে হয়নি, স্রেফ ভেবেছিলাম যে সুমনের বাংলা ভাষা বড় বেশি সিলেবাস-গন্ধী।

আমরা যাদের প্রথম মানবজীবন স্মৃতির উন্মোচন হচ্ছে আশির দশকের শেষভাগে, আমরা জানি তখন বাংলা সংস্কৃতির কি দারুন বন্ধ্যাদশা চলছে। ৮৬ সালের হোপ এইট্টি সিক্স, যেখানে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে জ্যোতিবাবু সুভাষের পাশে বসে বলিউডি নাচগান দেখেছিলেন, তার থেকে একটা নার্সারি ননসেন্স রাইম শুরু হয়, 'শ্রীদেবীর কোলে/জ্যোতিবাবু দোলে'। তখন আমি প্রাথমিক স্কুলে। হেমন্ত মারা যান ৮৮ কি ৮৯ সালে (ঠিক মনে নেই), তখন কাগজে লেখা হয়েছিল, হেমন্ত মরে গিয়েও বাঙালি জাতিকে ঋণী করে গেলেন, নয়ত এবছর পুজোপ্যান্ডেলে হাওয়া হাওয়া আর ওয়ে ওয়ের যুগলবন্দী বাঙালির কানের দফারফা করে দিত (তখনকার দুটি ব্যাপক হিট বলিউডি গান)। বলা বাহুল্য যে সেবছর সব প্যান্ডেলের লাউডস্পিকার শুধুই হেমন্তময় থেকেছিল। এই উষর জমিতে সুমন বর্ষা হয়ে নেমেছিলেন, সেকথা আজ বোঝা যায়। বাংলা সিনেমায় যে কাজ করেছিলেন সত্যজিত, বাংলা কবিতায় যে কাজ করেছিলেন জীবনানন্দ, বাংলা গানে সেই কাজ করেছেন সুমন। তিনি ভগীরথ। আধুনিক বাংলা কবিতা ও আধুনিক বাংলা গানের মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছিল, তিনি তা ঘোচালেন। সুমনের থেকেই আমাদের পালটে যাওয়ার সময় হিসেব করতে হবে। অনেকে বলেন বাংলায় আরেকটা রেনেসাঁস হতে চলেছে। জানিনা। যদি হয়, তার শুরু সুমন।

কেন এই পরিবর্তন হয় গত কুড়ি বছরে (সুমনের তোমাকে চাই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে), তার পেছনে অনেকগুলি কারন নিহিত আছে। যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা বাঙালিয়ানা ব্যাপারটাকে বুঝতে চাই, আমাদের যাকে বলে স্টক-টেকিং করা দরকার। কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকা্তে হবে।

শুরুটা করা যাক বাঙালি জাতির শুরু থেকে। পাল আমলে আমাদের উৎস, মোটামুটি সবাই একমত হবেন। এর আগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আমাদেরই পূর্বপুরুষ, তবে ঠিক বাংলা ভাষা বলতে যা বুঝি তা ছিল না। বাংলায় তখন বৌদ্ধ ধর্ম। পূর্ববঙ্গে যারা নাবিকের কাজ করতেন, তাদের একটা বড় অংশ নবম দশম শতাব্দিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন, কারণ ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের বাণিজ্য তখন ইসলামের নিয়ন্ত্রণে। এদিকে বাকি ভারতে তখন সনাতন ধর্মের পুনরুত্থান হচ্ছে। এমন সময় বাংলায় কর্নাটক থেকে আসা গোঁড়া সনাতনধর্মী সেনরা রাজা হলেন, এবং যা করে গেলেন, তার সুদুরপ্রসারি ফল থেকে গেল। এরা বাংলায় হিন্দুধর্ম আনলেন। আসলে এই হিন্দু কথাটা তো মুসলিমরা ভারতে আসার আগে ব্যবহৃত হয়নি, এই ধর্মের পরিচয় ছিল সনাতন ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। সেই সনাতনধর্ম প্রথমবারের জন্য বাংলায় জাঁকিয়ে বসল। এর আগে গৌড়ের প্রথম স্বাধীন রাজা বলে যিনি পরিচিত, শশাঙ্ক (নিজেই ব্রাহ্মণ ছিলেন, ইতিহাস বলে), তিনিও চেষ্টা করেছিলেন বাংলায় সনাতনধর্ম প্রচলনের, এবং বলা হয়, বাংলায় প্রথম ব্রাহ্মণ তিনিই আনিয়েছিলেন উত্তরভারত থেকে। কিংবদন্তি এই যে গয়ার বোধিবৃক্ষ উপড়ে ফেলার পাপে শশাঙ্ক দুরারোগ্য কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন, এবং তখন এই ব্রাহ্মণদের আনা হল যাগ-যজ্ঞ করার জন্য। আরো একটা কি কারণে যেন এইসময় পূর্ব ভারতে বেশ কিছু ব্রাহ্মণ চলে আসেন আর্যাবর্ত্ম থেকে, সেটা আমার ঠিক মনে নেই।
এর অনেকপরে যখন সেনরা কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ আনলেন, তারা এসে দেখেন যে সেই শশাঙ্ক আনিত ব্রাহ্মণরা বেশ গোকুলে বেড়ে এখন সংখ্যায় সাতশ। তবে তাদের আর বিন্দুমাত্র বামনাই নেই, বাংলায় এসে একদম প্রাকৃতজন হয়ে গেছেন। এদের সপ্তশতী বলা হয়।
সেন আমলে বাংলায় প্রথমবারের জন্য সনাতন ধর্ম আসে। বর্ণভেদও এল। বৌদ্ধরা জাতিপ্রথা মানতেন না, বাংলায় মূলত পেশা-ভিত্তিক অনেকগুলি শ্রেণী ছিল। এবার তাদের সঙ্করবর্ণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে শূদ্রত্বের বিভিন্ন ধাপে বিন্যস্ত করা হয়।

মনে রাখতে হবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ একটি আধুনিক চিন্তা। এই ইমাজিন্ড কমিউনিটি কয়েকটি বিশেষ আর্থ সামাজিক কারণ ছাড়া গড়ে ওঠে না। কাজেই সেন আমলে যখন বাঙালিরা ভেঙেচুরে যাচ্ছেন, তখন তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিলই না, যে এর ফলে তাদের জাতি হিসেবে আগামি হাজার বছরের জন্য মেরুদণ্ড ভাঙা হল। আজ অনেকে একদেশদর্শীভাবে এর জন্য শুধু বিজাতীয় সেনবংশকে দায়ী করেন। ওরা অবাঙালি ছিলেন, কিন্তু শুধু সেটাই আমাদের দুর্দশার কারণ নয়। শশাঙ্ক তো বাংলারই সামন্তরাজা, অর্থাৎ বাঙালিই ছিলেন বলা যায়, কিন্তু তিনিও তো চেষ্টা করলেন সনাতনধর্মের প্রচলনের। গোটা ভারতে যখন বৌদ্ধধর্মের কণ্ঠরোধ হচ্ছে, সনাতনধর্মের জয়পতাকা উড়ছে, শঙ্করাচার্য ব্রাহ্মণ্যধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই আবহে বাংলায় অন্যকিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কি? বিশেষত আমাদের বাণিজ্যের অবস্থা তখন খুবই করুণ, পাল আমলের মুদ্রা দেখলেই বোঝা যায়। সেনরা তো স্রেফ কড়ি দিয়ে কাজ চালিয়ে দিলেন। বাংলার ও গোটা ভারতের বৌদ্ধদের সবথেকে বড় শক্তি ছিল শ্রেষ্ঠিদের সমর্থন, একটা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। সেই শ্রেণিটি দুর্বল হয়ে পড়ছেন, কারণ ইসলামের হাতে সাগর বাণিজ্য এবং পুরো পশ্চিম এশিয়া চলে গেছে। এমন অবস্থায় রাজাদের বয়ে গেছে বৌদ্ধদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত দেখাতে। আর বাংলার যা আর্থিক দুরবস্থা ছিল, তাতে এখানে সনাতনধর্মের পুনরুত্থান থেকে স্বতন্ত্র কিছু হওয়া সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। যে কারণে বৌদ্ধধর্মের পতন হল, সেই কারণেই কিন্তু খুব শিগগিরি ভারতেও ইসলামের পত্তন হবে এবং ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় দের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা বেরিয়ে যাবে। ইতিহাসের আয়রনি। ওরা যখন মহাউৎসাহে সনাতনধর্মের প্রচলন করছেন, ও বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদ করছেন, ওরা জানতেন না, এই ক্ষমতা বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু এই অল্পসময়টায় ওরা যা করে গেলেন, তা ভয়ানক। বাংলায় ছত্রিশ জাতের সম্মিলনে এক হায়ারার্কি শুরু হল, যা মোটেই ইয়ার্কি নয়।
কৃষি নাকি আমাদের ভিত্তি, আর শিল্প ভবিষ্যত। অন্তত উন্নততর বামফ্রন্টের তাই বক্তব্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি আর ভবিষ্যত কি কে জানে!