Sunday, February 27, 2011

রেনিগেডঃ যাদবপুর

রেনিগেডঃ যাদবপুর

প্লিজ়, ফিরে তাকিয়ো না, সোনা...

এইট বি তে বেজে চলে মৃদু হিম হেমন্ত ঘড়ি
এনুই গুঁতোয় হয় এ দিনের শুরু আর শেষ
কে এম আরে খোঁচা খেলে এ লাইফ কি হেবি ডিভাইন
জেনে নিয়ো। কেন কি যে, তাকালেই, বেবি, খাবে কেস

ওগো পাতা, ঝরে গেলে ? আমি যে এখনও ডালে ঝুলি
প্যাঁদানির ভয়ে, জানো ! কেউ ছেড়ে কথা বলছেনা
চাঁটগায়ে মালাউন, গুজরাটে আমি হই মোল্লা
কোথায় তাকাব, তাই ঢুকুঢুকু... আর ভাল্লাগছে না

তুমি যদি ঢপ গেলো, আমি যাই এ সি ক্যানটিনে
তুমি ডিএসও হলে, আমি ঠিক এসএফআই হব
তুমি শালা কবি হলে, আমি হোল রাত পানু দেখি
মাইরি, তাকিয়ো না। আজ রাতে রশেবশে রব...

ড্যামিট, দ্যাখো যদি। আর তো কেয়ার করব না
তবুও, বিসিচ ইউ... প্লিজ় ফিরে তাকিয়ো না সোনা

রোমন্থণ

এমন বসন্ত দিনে...বাড়ি ফের মাংস কিনে...

এই সব বসন্ত সন্ধ্যায় পূর্বস্মৃতি ফিরে আসে, আর তুমিও আমার কাছে ফেরার চেষ্টা করেছিলে, যখন মনে হয়েছিল সম্পূর্ণ মানুষজন্ম কেটে যাবে শুধু অতীতকথনে, আর আঙুল ছুঁইয়ে পারমিতা কেটে পড়ল অথচ ঘড়িতে মোটে সাড়ে ছটা, আমি সেরকম সন্ধ্যার শপথ নিয়ে বলছি, বইমেলা ময়দান থেকে সরে যাবার দুঃখ আমরা এখনও দুই ভুরুর মাঝে জমিয়ে রাখি, আর খুব সম্ভবত আমি এই জবানবন্দি শেষ হওয়ার আগেই কলকাতা ছেড়ে চলে যাব, তাই বলে তুমি উড়ালপুল দিয়ে ভিক্টোরিয়া থেকে পার্ক সার্কাসে যাওয়ার সময় ক্যামাক স্ট্রিটের দিকে অপাঙ্গে তাকানো বন্ধ কোরো না, কারণ ওখানে ভিন্ন ডাইমেনশনে আমাদের দু একটি প্রতিচ্ছবি এখনও উত্তর অভিমুখে হেঁটে চলেছে, যেমন দুহাজার এক সালে আমরা হেঁটে চলতাম, আমি আর আমার পুরুষবন্ধু অভিজিত, সমান্তরালে সেই লক্ষ্যহীন এক্সাইড যেখানে আমার পূর্বপুরুষরা একটি সওদাগরি আপিসে বংশপরম্পরায় চাকরি করতেন, এও বলা দরকার যে হাজরা থেকে লেক মার্কেট পর্যন্ত পায়েলের হাত ধরে হাঁটতে গেলে তখন কোনও প্যারোলের আবেদন করতে হত না, আজ যেরকম প্রবাস থেকে ফিরতে গেলে করা বাধ্যতামূলক, এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ গাইতে গেলে আজ এই সব পুরোনো পাপাচার বড় মনে পড়ছে, কারণ আজ বেমানান রকমের পবিত্র প্রফেশনে চলে এসেছি, অথচ এখানে আসার কথা ছিল না, বাঘা যতীনে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকতে থাকতে কি করে যেন আমি দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি, কিন্তু কলকাতাই তো কাছে পড়ত, এদিকে কসবায় বন্ধুর চারতলার ফ্ল্যাটে দুর্গাপুজোয় অষ্টমীর রাতে এক মৃত মানুষকে বন্ধ দরজায় করাঘাত করতে শোনার পরেও আমি শালা মার্ক্সবাদে বিশ্বাস হারালাম না, তবে ভাল্টের বেনিয়ামিনের চ্যালা হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, অবশ্য একসময় এই আমিই এসএফআই এর মিটিং এ বসে সন্ত্রাসের বিস্তারিত পরিকল্পনায় অংশ নিয়ে ভেবেছিলাম, বিপ্লব এভাবেই দীর্ঘজীবি হবে...



পহেলি বার...মহব্বত কি হ্যায়...আখরি বার...মহব্বত কি হ্যায়

আমাদের পার্ট টুর সিট পড়েছিল সেন্ট জ়েভিয়ার্সে, আর তিন বছরের কলেজ জীবন শেষ হয়ে এল যেদিন, আমরা অনেকেই বুঝতে পারিনি এরপর কোথায় যাওয়া দরকার, মেয়েরা পরীক্ষা দিয়েছিল আচার্য জগদীশ বসু কলেজে, রবীন্দ্র সদনে গুলতানি করার জন্য একত্রিত হয়ে দেখা গেল খুব ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে, তাই আমরা গা ঘেঁষে জড়ো হয়ে বসলাম, অনেকেই গর্ভযন্ত্রণা কাকে বলে বুঝতে পারছিল, কারণ বর্তমানের গর্ভ থেকে ভবিষ্যত এবার জন্ম নিতে চাইছে, যেমন আবহমান কাল ধরে চলে আসছে, আমরা রবীন্দ্র সদন থেকে বির্জিতলাও ফিরে দেখলাম, তারপর হেস্টি আলিপুরির আস্তানা বেলভেডিয়ার হয়ে উৎসভূমিতে ফিরেছি, হাজরা মোড়ে তখন রাত সাড়ে নটার কলকাতা উত্তর-আশ্লেষ তৃপ্তি নিয়ে শুয়ে আছে, এবং সেই ছাড়াছাড়ির পরে আমরা সবাই আর কখনো একসঙ্গে দেখা করতে পারিনি, এলিয়ট পার্কে দুহাজার নয় সালে চেষ্টা হয়েছিল অবশ্য, কারণ পারিজাতের কাঠি রোল এখনও আলোচনার সেরা সঙ্গত, যদিও যমুনা, গ্লোব আর লাইট হাউস এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা পার্ক স্ট্রীটের উত্তরে যেতে কোনও উৎসাহ পেলাম না, নিউ এম্পায়ারে হিন্দি ছবি, যাতে সবাই একমত হল যে ঘোর কলিকাল চলছে কলকাতায়...



জাদু হ্যায় নশা হ্যায়, তুঝকো ভুলাকে অব যাউঁ কাহাঁ

হার্বার্ট দেখে প্রচুর পুড়কি খেয়ে পুরোনো কলকাতাকে প্রেম নিবেদন করলাম কলেজ স্ট্রিটে, অথচ সে মাগিটা চলে গেল ধাপার মাঠে মিলনমেলায় (আমি আজকাল হরিয়ানভি শিখছি সেজন্য কিছু রুক্ষতা চলে আসতে পারে), বোধহয় ব্যর্থ প্রেমিকের মত আমি আজীবন কলকাতাকে ফ্যান্টাসাইজ় করে যাব, তবে এও তো ঠিক যে আমি অলীক দিগন্তে স্পেশ্যাল এজুকেশন জ়োনে গিয়ে একপাল মোষের তাড়া খেয়ে ওঠার আগেই যাদবপুরে লেডিস হোস্টেলের বাইরে তোমার সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম, এবং এভাবে মানুষ গ্র্যাজুয়েট থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হয়ে ওঠে, তবে আয়রনি এই যে মকাইবাড়ির চা খাওয়ার জন্য আমাকে কলকাতা ছেড়ে দিল্লি আসতে হল...



দৃষ্টিতে ঝরাও আগুন, ইতিহাস সেঁকে নেবে রুটি

ওফ কি জঘন্য আগুন জ্বেলেছ এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, অশনমিতা, আর আমাকে সাক্ষী রেখে তুমি ন্যাশনাল লাইব্রেরি কমপাউন্ডে তোমার প্রোজেক্ট প্রোপোজ়াল হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে একটা ছোট্ট কুত্তুছানাকে নিয়ে আদর করে যে বাঙালি রোম্যান্টিকতা দেখালে, তা শুধু এই কারণে নয় যে তখন সত্যি গঙ্গার দিক থেকে খুব হাওয়া বইছিল, আসলে আলিপুরের খাঁচায় থাকা বাঘ সিংহরা মাঝে মাঝে বাইরে বেড়িয়ে এসে হুদো হুদো প্রফেসরদের একটি থাপ্পড় মেরে যেতেই পারে, যারা কলেজ সার্ভিস কমিশনে সিপিএম এর এঁটোকাঁটা চেটে চেটে গন্ডার হয়ে গেছে, আর আমি ভুল বললে শুধরে দিও, আমি কলকাতা ছেড়ে আসার রাতে তোমার অরন্ধন ছিল যতদূর মনে পড়ে, তোমার হতাশা ঘটালে আমি দুঃখিত, মিয়া কুইপা, তবে আমি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাব ভাবিনি কখনও, এবং আমি আজ এ যুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট খুলছি পশ্চিমপ্রান্তে, তুমি পূর্বদিকে আমার অপেক্ষায় থেক, আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ইতিহাস উড়িয়ে দিচ্ছে না...

৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১

Sunday, February 13, 2011

প্রেম

রামকৃষ্ণও নরেনকে গান গাইবার জন্য ঈঙ্গিত করলেন। আজ গুরু বেশ সুস্থ আছেন, তাই শিষ্যরা সকলেই উৎফুল্ল। নরেন গান ধরলঃ
প্রভু ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম তেরা
তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, তু দেওয়ান মেরা।
দো রোটি এক লঙ্গোটি, তেরে পাস ম্যয় পায়া
ভগতি ভাব আউর দে নাম তেরা গাঁবা...
এর পর সে গাইলঃ
নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী...

গান শুনতে শুনতে মহেন্দ্রলাল এক দৃষ্টিতে রামকৃষ্ণের দিকে চেয়ে রইলেন। এক সময় রামকৃষ্ণ বিছানা ছেড়ে নামলেন মেঝেতে, হাত তুললেন নাচের ভঙ্গিতে। অন্য দিন হলে মহেন্দ্রলাল প্রবল আপত্তি জানাতেন, সামান্য পরিশ্রমেই রোগ বেড়ে যাবার সম্ভাবনা। আজ কিন্তু কিছুই বললেন না। একটু নাচতে গিয়েই রামকৃষ্ণের ভাব সমাধি হল সামান্য সময়ের জন্য।
ডাক্তারের চক্ষু দিয়ে জল গড়াচ্ছে। গলার কাছে যেন আটকে রয়েছে কিছু। তিনি রুমাল বার করে মুখ মুছলেন।
স্বাভাবিক হয়ে রামকৃষ্ণ বললেন, ও কি গো, তুমি কাঁদছ নাকি?
মহেন্দ্রলাল বললেন্‌ ভাল গান শুনলে আমার বুকের ভেতরটা মোচড়ায়।
রামকৃষ্ণ কাছে এসে বললেন, তবে তো তোমার হয়ে এসেছে গো, তুমি মজেছ! আমায় থ্যাঙ্ক ইউ দাও!
মহেন্দ্রলাল ধরা গলায় বললেন, সে কথা কি তোমাকে মুখে বলতে হবে? আমি সামান্য ডাক্তার, তোমার কাছে এসে কত কী শিখলাম!
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম আলো)


রাজনীতি না করলে এই প্রজন্মের ছেলেকে দিয়ে সামাজিকতা করানো বেশ মুশকিল। আমি আসলে বেশ অসামাজিক। বউ আর বই নিয়েই সবথেকে ভালো থাকি, আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক পাপাচার, যেমন গান, সিনেমা, গড়গড়া (হ্যাঁ, আজকাল একটা আলবোলা টেনে থাকি), আর ইন্টারনেট, ব্যস। কিন্তু যেদিন থেকে শিক্ষক রাজনীতিতে এসেছি, চাই বা না চাই, সবার সঙ্গে খেজুরে করে, এবং দরকারি লোকেদের সঙ্গে দহরম করে সময় ব্যয় করতে হয়। যদিও কুঁড়ে, তবে হাতে গোনা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আমন্ত্রণ ফেলা যায় না। একটি নিমন্ত্রণ রক্ষায় যেতে হল একটি কলেজে, তবে আমি যেমন খচ্চর, সেমিনার কাটিয়ে দিয়ে, একটি ডকু প্রদর্শন এড়িয়ে, সুফি গানের অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগে গিয়ে পৌঁছলাম। ভাবলাম, যাই হোক, গান তো শোনা যাবে। গিয়ে দেখি, ডি ইউ টি এর সেক্রেটারিও এলেন। তিনি অবশ্য হাত টাত মিলিয়ে, মিনিট পাঁচেক গদিতে পশ্চাতদেশ ঠেকিয়ে সরে পড়লেন। একটি সুফি ব্যান্ড পারফর্ম করছিল। শুনতে থাকলাম।
শুনতে শুনতে ঘোর লাগতে লাগল। অসাধারণ বললে কম বলা হয়। কি উদ্দীপন, কি ভীষণ এক প্রেমের যুদ্ধঘোষণা মানুষের সব পরাজয়কে তুচ্ছ করে, মৃত্যুকে অতিক্রম করে, সেই আবেগ যা মানুষকে লহমার মধ্যে চিরন্তনকে ছুঁতে দেয়, অথচ যা নিবিড়ভাবে, তীব্রভাবে শরীরী, যা এই জগতের ধুলোকাদা মাখা সব আবিলতার মধ্যে মিশে থাকা এক চিমটে ঈশ্বরবিন্দু, এমন আকুলতা যার সঙ্গে বাউল, বোষ্টম, সুফি রা আত্মনিবেদন করেন, সেই সব মিলেমিশে আমাকে কতবার আবিষ্ট করল, মনে হল কয়েকবার মরলাম আর পুনর্জন্ম হল। মনে হচ্ছিল বেশিক্ষণ হৃদয় ও মস্তিষ্কের এমন মস্তি ও অর্গাজ়ম সহ্য করা বেশ কঠিন। কখনও খাজা মইনুদ্দিনের প্রতি প্রবল আকুতি, আমাকে গ্রহণ কর, কখনো সেই আকুতি ফিরে যাচ্ছে প্রেমিকার প্রতি, কবির নিজস্ব ঈশ্বরীর প্রতি, আ যা পিয়া, না যা পিয়া, ফিরে এস, ফিরে এস, তুমি জিতেছ, আমি হেরে গেছি, এই তো স্বীকার করলাম, ফিরে এস। এই দেখুন, এখনও লিখতে গিয়ে চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে... কখনও রাধা বলছেন, ও যেন ওর রঙে আমায় রাঙিয়ে দেয়, আর ধোপারা সারা জীবন ধুলেও সেই রঙ উঠবে না। কখনও মাতাল ও পাপাচারী কবি বলছেন, আমি যেখানে পড়ে আছি, ফেরেশ্তা সেখানে আসেন না, কিন্তু আমি জানি তুমি আমার জন্য আসবে। এরপর বুল্লে শাহ বলছেন, না না, ঈশ্বরের অভিমান নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না, সে লোক তো সামান্য প্রার্থনা শুনলেই জল হয়ে যায়, কিন্তু যা সবথেকে কঠিন সেই কাজটা কর, আগে বান্ধবীর মান ভাঙাও। এঁরা প্রাণ দিয়ে, শরীর দিয়ে, কলিজা দিয়ে গাইছিলেন ও বাজাচ্ছিলেন, মাঝে দেখলাম আমার শুনতে এত অসহ্য লাগছিল, ওরা গাইছেন কি করে? গায়কদের মনে হচ্ছিল দিব্যোন্মাদ, একটা গান তো সরাসরি ঘোষণা করল, আমরা দিওয়ানা, আমরা ধর্মের কুটকচালি কি বুঝব, ওসব তো মোল্লা আর ব্রাহ্মণদের জন্য, ওরা আল্লাকে কাবা আর ভগবানকে কাশীতে বন্দি করে রাখে, আমরা দেখ শুধু এই উপাসনা জানি, এর নাম প্রেম।
এখন ব্যাপারটা হল, এই সুফি তো সেই ঈশ্বরের ভাষা, যার কথা এখন ঈগলটন ওঁর মত করে বলার চেষ্টা করছেন। জীবনের অর্থ যে ভালবাসা, এবং মৃত্যুকে জয় করতে পারে শুধু সে-ই, এবং মানুষ হয়ে মানুষকে প্রবলভাবে ভালবাসাই তো সাম্যের প্রধান ইন্ধন। সাম্য মানে তো ভক্তি আন্দোলন, তার মানে তো চৈতন্য, তার মানে তো মস্ত কলন্দর, তার মানে তো মানুষপুত্র যীশু, আর মহম্মদও সেই ভালবাসার কথাই বলছেন সুফি সাধকদের মতে। কিভাবে এমন ঈশ্বর-উপাসনা ওয়াহাবি নামক লগুড়ধারি গোরিলার কাছে হেরে যেতে পারে, এবং যদি হেরে যায়, তখন, ঈশ্বর নিজেই যে পরাভূত!
চৈতন্যের আন্দোলন কি রকম ভাব উচ্ছাস তৈরি করেছিল, তার বর্ণনা পড়েছি। নামগান ঠিক কিভাবে সবাইকে নাচাত, সেটা এই সুফি ব্যান্ডের অনুষ্ঠান দেখে টের পেলাম। কেসটা রীতিমত জন্ডিস। আর এরা যেন আমার মনের ভাব টের পেয়েই দমাদম মস্ত কলন্দর গাইতে গাইতে টুক করে হরিবোল হরিবোল বাজিয়ে দিলেন ব্যাকগ্রাউন্ডে। ধ্যাত্তেরি, শালা, মনে হচ্ছিল এইবার সমস্ত অপ্রেমকে টুসকি মেরে আমিও নাচতে লেগে যাই। আমার বন্ধুটি, তিনি ওই কলেজে ইতিহাস পড়ান, নাচছিলেন। আমি বাঙালি ভদ্রলোক কিনা (মনসুন ওয়েডিং ছবিতে এই সংক্রান্ত একটি ডায়ালগ ছিল, মনে পড়ছে), তার ওপর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মেম্বার, তাই নাচতে লজ্জা হল। নাচিনি, তবে চোখের জল এইভাবে কন্ট্রোল করা যায় না, হাত পা যেভাবে খানিকটা বশে রাখা যায়।
পৃথিবীর মুক্তি প্রেমে। মানুষের মুক্তি মার্ক্স যে কিছু বিমূর্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে খুঁজেছেন, তার কারণ ওঁর সময়ে এনলাইটেনমেন্ট প্রজেক্ট শেষ হয়নি। মার্ক্স ভয়ানক ভুল করেছেন তাও বলা যায় না। গায়ক এক জায়গায় ভণলেন, এক বাদশা এক সুফি সাধককে বলে পাঠিয়েছিলেন, আমি দুনিয়ার মালিক, কিন্তু আমি আপনার অনুরাগী, আমি আপনার দরগায় আসব। সেই সাধক উত্তর দিয়েছিলেন, দেখুন, দুটো দরজা আছে আমার দরগায়। আপনি যে-ই একটা দরজা দিয়ে ঢুকবেন, আমি অন্যটা দিয়ে বেরিয়ে যাব। সুফির সঙ্গে ক্ষমতার আপস নেই।

এই বিপ্লব অসমাপ্ত রয়েছে, এই বিপ্লবকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া আমাদের কাজ। আর ভুল করবেন না, এর মানে কিন্তু কোনও বিমূর্ত বিশ্বজনীনতা নয়। সুফি ভীষণ পার্টিকুলার, ভীষণ কনক্রিট, মেটেরিয়েল, সুফি কে পেতে হলে একটি নির্দিষ্ট মাধ্যম চাই। আপনি যেমন শরীরী প্রেম করতে গেলে একটি মানুষকে করবেন, বিশ্বমানবের সঙ্গে সেটা সম্ভব নয়। সুফির প্রেমের মাধ্যম তার ভাষা। এঁরা যেমন পারসীক, পাঞ্জাবি, হিন্দভি, ব্রজ বিভিন্ন ভাষায় গাইলেন। পারসীক ভাষায় সেই বিখ্যাত প্রেমের মন্ত্র, তু মন শুদি, মন তু শুদম, মন তন শুদি, তু জাঁ শুদম, তুমি আমি হলে, আমি তুমি হলাম, আমি শরীর হলাম, তুমি প্রাণ হলে, তা যেমন সব মানুষকে আচ্ছন্ন করে, তেমনই মনে করিয়ে দেয়, প্রেম আসলে শরীর ও ভাষার মত, নির্দিষ্টকে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয়। মানুষ লিঙ্গুইস্টিক প্রাণি। বিশ্বজনীনতা আসে আমার বাঙালিয়ানাকে আশ্রয় করে, বাঙালিয়ানা-বিহীন বিশ্বমানবতা যারা কল্পনা করেন, তাঁরা জানেন না, তারা একটি নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যবাদি মতবাদের ধারক।

ঘৃণা

একবার দিল্লির একটি কলেজ জুড়ে প্রবল গুজব ছড়াল, শ্রী অমুক ঝা এইবার ভাইস প্রিন্সিপাল হচ্ছেন। সেই লোকটি সম্পর্কে যারা অবহিত ছিলেন, তারা সবাই বেশ অবাক। ভদ্রলোক হচ্ছেন, যাকে এদেশের ভাষায় বলে চম্পক। গুড ফর নাথিং, নিজে একবার রটিয়েছিলেন যে উনি খুব শিগগির ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তবে তার আগে সুপ্রিম কোর্টের জজসাহেব হওয়ার আশু সম্ভাবনা (বিহার থেকে আইনের একটি ডিগ্রি বাগিয়েছিলেন একদা), এক জ্যোতিষী নাকি ওকে হাত দেখে বলেছে। কাজেই সবাই খোঁজাখুঁজি করে দেখলেন যে এবারও গুজবের মূল সুত্রটি উনি নিজেই, উনিই ছড়িয়েছেন।

সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, সিপিএম নাকি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। প্রবল গুজব বাজারে। দিল্লি অবধিও পৌঁছে গেছে। সিপিএম বিরোধি বিকল্প বাম মঞ্চের একজন পাঞ্জাবি শিক্ষক নেতা আমায় শুধোলেন, সিপিএম নাকি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে? আমি জিগ্যেস করলাম, কোথথেকে জানলেন? জানা গেল, সিপিএম এর একজন ওঁকে বলেছে।

১২ই ফেব্রুয়ারি রাতে স্টার আনন্দ একটি ভিডিও ক্লিপিং দেখায়। হলদিয়ার প্রাক্তন এম পি লক্ষণ শেঠ কে দেখা যাচ্ছিল। একদল মানুষ তাকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, তিনি গাড়িতে বসে বলছেন, এই চুপ, তোমরা তৃণমূল, এ-এ-এই, এক মারব, তিনি মারার জন্য হাত তুলে বোঝালেন, যে কিভাবে মারবেন। এক দরিদ্র মহিলা, সম্ভবত পুলিস ও হার্মাদের হাতে পিটুনি খেয়েছেন, তাঁর একটি বাচ্চা ছেলে আছে, তার হাঁটুতে দগদগে একটা ক্ষতচিহ্ন, লক্ষণ সেই মহিলাকে বললেন জল্লাদ, এবং সেই মহিলা চিৎকার করে বলছিলেন, যে তারা একসময় লালঝান্ডা নিয়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ করেছেন, তখন তো জল্লাদ বলা হয়নি।

সিপিএম এর লোকেরা ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সর্বত্র বলে চলেছে তৃণমূল আর মাওবাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। সিপিএম এর বিরোধিতা করলে এ দুটোর একটা নির্ঘাত না হয়ে যায় না, এমনকি দুটোই হতে পারে। এবং গোয়েবলসীয় কায়দায় এক কথা হাজার বার বললে যেমন হয় আর কি, অনেকেই এটা খেয়ে ফেলেছেন। যেটা পশ্চিমবঙ্গবাসি মাত্রেই জানেন, মাওবাদিরা একদম মাইক্রোস্কোপিক সেখানে, এখনও পর্যন্ত, তবে যে কায়দায় সিপিএম নন্দীগ্রামে ও লালগড়ে সূর্যোদয় ইত্যাদি ঘটিয়েছে তাতে মাওবাদিদের সামনে বা যারাই হিংসার রাজনীতি করেন তাদের জন্য একটা বড় সুযোগ এসে গেছে, কারণ সিপিএম প্যাঁদানি ছাড়া আর কোনও ভাষা বোঝে না, আর যারা লাথের ভুত, তারা বাতে মানবে কেন, তাই সাধারণ মানুষ আজকাল সিপিএম মরলে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন। বিষয়টি বিপজ্জনক, এবং পশ্চিমবঙ্গের সাড়ে সর্বনাশ হওয়ার চমৎকার সম্ভাবনা এতে গভীরভাবে প্রোথিত আছে।

সিপিএম কে তৃণমূল হারাচ্ছে না। তৃণমূলের নিজস্ব শক্তি সংগঠন যা আছে, তার কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। সিপিএম কে হারাচ্ছে সিপিএম থেকে বেরিয়ে আসা মানুষেরা। যারাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা এটা জানেন।

লক্ষণ শেঠ এর ক্লিপিং এ আরো বাকি ছিল। দেখা গেল এবার দৃশ্যান্তর। নেতা এখন একটি ভবনের ভেতরে, একদল বিক্ষোভকারির সামনে গর্দভবিনিন্দিত গলায় এবার নেতা হুমকি দিচ্ছেন, এ-এ-এই! কে? কে বলল হার্মাদ? তোরা হার্মাদ, তোরা জল্লাদ, তোরা তৃণমূল। আস্ফালন করছেন, এমন মারব না!

আবার দৃশ্যান্তর। এবার রামানুজ বলছেন, এরা নৈরাজ্যবাদি, সুতরাং হচ্ছে (সিপিএম এর বিমান বসু থেকে, বিনয় কোনার থেকে, নিরুপম সেন থেকে পুঁটি নেতা পর্যন্ত সবাই এই "হচ্ছে" শব্দটা মুদ্রাদোষ হিসেবে ব্যবহার করেন, রেজিমেন্টেশন কাকে বলে তা এদের দেখলে টের পাওয়া যায়, দিল্লিতে গোপালন ভবনে বসে ইয়েচুরি যা বলছেন, তা হুবহু সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে পার্টির নেতা কাম প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার বমি করে দেন) এই সব জল্লাদদের মানুষ দেখে নেবে।

আমরা, মানে আমি ও আমার স্ত্রী একবার হলদিয়ায় গেছিলাম। তখন চাকরি খুঁজছি। ওখানে লক্ষণবাবুরা শিক্ষার ভাল বেসাতি করেন, Icare নামে একটা কম্পানি খুলেছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ম্যানেজমেন্ট কলেজ, ল কলেজ, কি নেই...আমরা ইন্টারভিউ দিলাম, বলা হল নির্বাচিত হয়েছি, জানতে চাওয়া হল কবের মধ্যে জয়েন করতে পারব, আমরা বললাম একটু ভেবে দেখার সময় চাই, সত্যি বলতে গেলে কি, কলকাতা থেকে এত দূরে, এত প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে প্রচুর ঢক্কানিনাদ সত্বেও উন্নয়ন প্রায় কিছুই হয়নি, একজায়গায় চলতে চলতে বাসের কন্ডাক্টর ঘোষণা করেছিল, সিটি সেন্টার, সিটি সেন্টার, সেখানে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, একটা ধু ধু মাঠ, কয়েকটা গরু চরছে ইতস্তত, এরকম জায়গায় যাওয়াটা বেশ কঠিন।

ফিরে এলাম, বললাম, দিন দুয়েকের মধ্যেই জানাব। তা আমরা কিছু জানানোর আগেই, ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর ফোন করে বললেন, আমাদের এসে আরেকবার ইন্টারভিউ দিতে হবে। কেন? না আগেরবার লক্ষণ শেঠ ছিলেন না, উনি নিজে একবার ইন্টারভিউ নেবেন, তারপরে চাকরি পাকা হবে। ভাবুন, আমাদের ইন্টারভিউ নেবে লক্ষণ শেঠ! বলা বাহুল্য, এই প্রস্তাবের উত্তরে কয়েকটি কাঁচা খিস্তি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, তখনও বেঙ্গলে থাকি, তাই বিনীতভাবে আমাদের অসহায়তার কথা জানিয়ে হলদিয়ায় না যেতে পারার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলাম।

এটা সত্যি ঘটনা। আরেকটা ঘটনা যেটা ঘটতে চলেছে, সেটা বলে রাখি, সিপিএম এর নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ বিধানসভা নির্বাচনে ওদের পার্টি হেরে ঢোল হওয়ার পরে বাংলা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবেন, কারণ মানুষের ঘৃনা যে জায়গায় পৌঁছেছে, ওদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি জ়েড ক্যাটিগরিতেও নিশ্চিত করা যাবে না। ওরা লিঞ্চিং এর শিকার হতে পারেন, কারণ, মানুষ ওদের আর সহ্য করতে পারছেন না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, স্টার আনন্দের ক্লিপিং এ লক্ষণের আস্ফালন দেখতে দেখতে আমারই হাত নিশপিশ করছিল, মনে হচ্ছিল ডাস্টার দিয়ে মেরে মেরে ওর মাথার ঘিলু বার করে দিই। মানুষের এত ঘৃণা, এত অভিশাপ মাথায় নিয়ে এই ফ্যাসিস্টরা কোথায় পালাবে, আর যখন এদের রথের চাকা বসে যাবে, কোন ন্যানো-আকাঙ্ক্ষী, সেক্টরফাইভ-গামী, আজকাল ও গণশক্তি পড়া সরকারি অফিস-স্কুল-কলেজ এর চাকুরিজীবি এদের দেহ-রক্ষা করবে?