Tuesday, September 7, 2010

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ

দুই

একবার কলকাতায় গিয়েছি একটা কাজে। তখন আমদের বসবাস দিল্লিতেই। হাতে পয়সাকড়ি যা আছে, তাতে দু-তিনদিনের বেশি চলবে না। ক্রেডিট কার্ডের কোনও গল্প নেই। তখনও আমি দিল্লিতে অধ্যাপনার চাকরি পাইনি, ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছি। সবাই করুণার হাসি হেসে বলছেন, চেনাজানা ছাড়া কি আর জেনেরাল ক্যাটিগরিতে চাকরি হয়! স্ত্রী ফোনে বলছেন দিল্লিতে ফিরে যেতে, কাজ মাথায় থাকুক। কিন্তু আমার দুটো একটা বিষয়ে বেশ বাঙালপনা আছে। যদিও অর্ধাঙ্গিনী বলেন যে আমি ঘটিফায়েড বাঙাল। সেটা খাদ্যাভাসে।

আমি রবীন্দ্র সদনের সিঁড়ির এককোনায় বসে ছিলাম। সঙ্গে কোনও বন্ধু নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই চত্বরটা খুব প্রিয় ছিল। সবদিনের মতই সেদিন কিছু একটা অনুষ্ঠান চলছে। কিছু বিশেষ অনুষ্ঠান, কারণ একের পর এক ধুতি পাঞ্জাবি ও জমকালো শাড়ি পরিহিত অভিজাত পঞ্চাশোর্ধ বাঙালি নারী-পুরুষ এসে গাড়ি থেকে নামছিলেন, এবং উদ্যোক্তারা সমাদর করে তাদের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। কোনও অল্পবয়সী অভ্যাগতকে দেখিনি। আমার মনে হচ্ছিল, যে এটাই খুব সম্ভবত বাঙালিয়ানা। এক্সক্লুসিভ, নাক-উঁচু, উচ্চ-ভ্রূ, মেনোপজ়াল, এবং সংস্কৃতিপরায়ণ। এর সঙ্গে সাধারণ বাঙালির, জীবনযুদ্ধে নামা বাঙালির, যুবা-বাঙালির যোগ কোথায়?

বাঙালি বললে বহুদিন ধরে শুধু বাঙালি হিন্দু বোঝানো হয়েছে, আজও পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্বল্পশিক্ষিত মানুষ এইভাবে বাঙালি শব্দটা ব্যবহার করেন। আমরা বাঙালি এবং ওরা মুসলমান। আর বাঙালি হিন্দু বললে অবশ্যই বাঙালি ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ। আমাদের দেশভাগ হবে না তো কাদের হবে!

বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি? সাধারণ বাঙালির সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কি জ্যাঠা জাতীয়তাবাদ বলে যায়, অর্থাৎ এ শুধু বিভিন্ন ক্ষেত্রের জ্যেষ্ঠদের একচেটিয়া? স্টার আনন্দের প্যানেল আলোচনায় যারা স্টুডিও আলো করে বসে থাকেন, তাঁরা কি আমাদের জাতির অভিভাবক? বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানে কি অবাঙালি বা বিদেশিরা কোনও বাঙালিকে সাফল্যের স্বীকৃতি দিলে তাই নিয়ে খবরের কাগজ ও নিউজ় চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ়? একজন লিখেছিলেন, বাঙালির শুধু সৌরভ গাঙ্গুলি ও অমর্ত্য সেন, দুটি বই ল্যাজ মোর নাই রে! যেমন কিছুদিন আগে আনন্দবাজারে খবর হল যে বাঙালি বিজ্ঞানি আমেরিকার জন্য যুদ্ধবিমান বানিয়েছেন। যেমন সেরা বাঙালির পুরস্কার দেওয়ার জন্য আ.বা.প. সিঙ্গাপুর, দিল্লি, বম্বে ও অ্যামেরিকা থেকে বাঙালি খুঁজে আনে। প্রশ্ন হল, এই হ্যাংলামি ও আদেখলেপনা কি বাঙালি জাতীয়তাবাদ? বিদেশ-বিভুঁইয়ে দু-একটি বাঙালির সাফল্যে ছাগলের তিননম্বর ছানার মত লম্ফ দেওয়া কি বাঙালি জাতীয়তাবাদ? এবং সর্বোপরি, এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি কেন হল, যে বাঙালির জীবনে বামফ্রন্ট হল ভিত্তি আর আনন্দবাজার হল ভবিষ্যৎ?

হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি শাসিত হচ্ছে comprador শ্রেণির দ্বারা। বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তির পরে যে দুটি ধর্ম আমাদের গ্রাস করেছে, সনাতন ধর্ম ও ইসলাম, দুটিই পশ্চিম থেকে আগত। বৌদ্ধধর্ম আমাদের মননের খুব কাছাকাছি ছিল, ভৌগলিক দিক থেকেও সেই নৈকট্য খুব প্রকট, কারণ এটি ছিল পূর্বভারতের ধর্ম। সনাতন ধর্মের জাতপাত আমাদের কুৎসিত অভিশাপ। আর পূর্ববঙ্গে প্রচারিত ইসলামের গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, ভিন ধর্মের প্রতি নোংরা বিদ্বেষ এবং ভিনধর্মীকে নিকেশ করে পূণ্যার্জন এসবের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল।
আমাদের সমাজ যাঁরা শাসন করছেন, গত হাজার বছর ধরে করে আসছেন, তাঁরা যথাক্রমে সনাতন ধর্ম ও ইসলামের অনুমোদিত দালাল শ্রেণি। এটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান দুর্বলতা। এই সমস্যা, যেমন ধরুন, দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের হয়নি। কেন হয়নি সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।

বিষয়টা অবশ্য এমন একদেশদর্শী নয়। বাঙালি উচ্চবর্ণ সবসময় দালালি করেননি। ভক্তি আন্দোলন এই সনাতন ধর্মী নিপীড়নকে কিছুটা স্তিমিত করেছিল। আমি চৈতন্যের কথা বলছি। আচারভ্রষ্ট, এই অভিযোগ এখানকার উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে বহুবার উঠেছে। বাঙালি ব্রাহ্মণকে উত্তরভারত ঠিক ব্রাহ্মণ বলে মানেও নি কখনও। তার কারণ অনেকগুলি। আমাদের উচ্চারণ, খাদ্যাভ্যাস, রক্তে প্রবল ভেজাল (বস্তুত বাঙালি উচ্চবর্ণের অনেকের গায়ের রঙ ঘোর কালো, ওদিকে বর্ণ কথাটার মূল অর্থই ছিল গাত্রবর্ণ। বাঙালি উচ্চবর্ণ নৃবিদ্যা অনুসারে অস্ট্রিক, মোঙ্গল, এবং দ্রাবিড় রক্তের অনেক বেশি কাছাকাছি, সেটা আমরা যারা উত্তরভারতে থাকি, ভালোরকম বুঝি)। আর সীমিতভাবে হিন্দু উচ্চবর্নের মধ্যে একটি রেনেসাঁস, রিফর্মেশন ও এনলাইটেনমেন্ট হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দিতে, সেটা নস্যাৎ করা উচিত নয়।

ইসলামের ইতিহাস আমি খুব বেশি জানি না, তবে লালন ফকির আছেন। যদিও তিনি আসলে হিন্দু ছিলেন, এবং সনাতন ধর্মের ছুঁৎমার্গের সমস্যায় পড়ে কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তা আমাদের জানা। বাঙালি মুসলমানরা অধিকাংশই ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ বা হিন্দু, এবং এই ধর্মান্তরকরণ তরবারির জোরে কিছুটা হয়েছে এটা সত্যি। ইসলামি শাসকরা ছ'শো বছর বাংলার অধিকারি ছিলেন এবং অধুনা বাংলাদেশ (যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম) ইসলামি মৌলবাদিদের খানিকটা দখলে। কাজেই এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ধর্মান্তরকরণ মূলত হয়েছে সনাতনধর্মের জাতপাতের সমস্যায়। সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গে ইসলাম এসেছিল সাম্যের বার্তা নিয়ে, নাবিকদের মাধ্যমে, আর পশ্চিমবঙ্গে তা ছিল পাঠান-মোঘল শাসকের রক্তচক্ষু। তাই এমন আশ্চর্য কাণ্ড দেখতে পাওয়া যায়। বাকি ভারতে ইসলাম ছড়িয়েছে একভাবে, বাংলায় অন্যভাবে। ইসলাম ভারতের পশ্চিমে থাকল, যা তার সাম্রাজ্য বিস্তারের itinerary তেই পড়ে। বাংলায় এসে সেটি পালটে গেল। পশ্চিম নয়, পূর্ব ইসলামে আস্থা জানাল। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম সেই সাম্যপরায়ণ প্রাক্তন বৌদ্ধদের খুব শিগগিরি গ্রাস করে নিয়ে এক মনোলিথিক ধাঁচায় পুরে দিতে দেরি করবেনা।

বাঙালি হিন্দু সমাজের দুটি প্রধান উচ্চবর্ণ, ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ, দুটিই এসেছে উত্তরভারত থেকে। কিংবদন্তি, রাজা আদিশূর পাঁচটি ব্রাহ্মণ ও পাঁচটি কায়স্থ আনিয়েছিলেন। আহা, সেই দত্ত কারও ভৃত্য নয় গল্পটি জেনে দত্তদের প্রতি আমার বেশ পক্ষপাত জন্মে যায়। যদিও অনেক বাঙালি আজও কায়স্থরা যে উত্তরভারতীয় তা ঠিক জানেন না। অমিতাভ বচ্চন একজন কায়স্থ। ওড়িশাতেও কায়স্থরা একটি প্রধান, আধিপত্যময় জাত এবং সেখানে এরা করণ বলে পরিচিত। পট্টনায়করা এই জাতের অন্তর্গত। এরা সিভিল সার্ভেন্ট ও কেরাণির কাজ করতেন, কাজেই সরকারের কাজে অপরিহার্য। বাঙালি বৈদ্যরা একটু অন্যরকম কেস, এ বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু লিখতে চেষ্টা করছি, তাই এখন আর কিছু লিখলাম না। বাঙালি নিম্নবর্ণের মধ্যে নমশূদ্ররা একটি ভীষণ আকর্ষণীয় ইতিহাস বহন করেন, এবং সে ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী ও কিঞ্চিত পড়াশোনা করছি, এবং তাঁদের বিষয়ে একটি লেখায় হাত দিতে চাই, তাই ও ব্যাপারেও আর কিছু লিখলাম না।

একটা বড় অংশের নিম্নবর্গীয় বাঙালিরা ইসলাম গ্রহণ করায়, উচ্চবর্নের বিরুদ্ধে, সনাতন ধর্মীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে যেভাবে দ্রাবিড় আন্দোলন গড়ে উঠতে পেরেছিল, সে সম্ভাবনা বাংলায় দেখা দেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাংলায় এস সি ফেডারেশন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, এর নেতারা মুসলিম লিগের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থন করেছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্বাধীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীও হন। এরপরের ইতিহাস অত্যন্ত ট্র্যাজিক। তিনি ১৯৫০ সালে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে আসেন, এবং কলকাতার ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের একটি বস্তিতে ৫৬ সালে মারা যান। বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্নের পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থনের জন্য দুয়েকটি হিন্দুপ্রধান জেলা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়, কাজেই উচ্চবর্গীয় নেতারা যোগেন্দ্রকে ক্ষমা করবেন না, জানা কথা। দেশভাগের ট্র্যাজেডি আসলে বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্ণের ট্র্যাজেডি। এবং সেই যে এস সি ফেডারেশনের শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যায়, আজ পর্যন্ত নিম্নবর্ণরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে (বাংলাদেশের কথা ছেড়েই দিলাম, সেখানে হিন্দুরা ক্রমশ দেশত্যাগ করছে) ব্রাত্য হয়েই আছেন, বাকি ভারতে যেখানে দলিতদের (অন্তত তাদের একটা অংশের) ক্ষমতায়ন হয়েছে। বাঙালি দলিত পূর্বে অর্ধচন্দ্র খেয়েছেন, আর পশ্চিমে মরিচঝাঁপি পেয়েছেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান সমস্যা এই। এদিকে ভদ্রলোক শাসিত, ওদিকে মুসলিম এলিট শাসিত (একজন ঐতিহাসিক লিখেছিলেন, এদিকে ব্রাবৈকা, ওদিকে শেসৈকা। অর্থাৎ এদিকে ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ, ওদিকে শেখ সৈয়দ কাজি)। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি আন্দোলন, যেটি আসলে কাঁঠালের আমসত্ব থেকে গেছে, এই ভদ্রলোক ডমিনেশন আর স্তালিনবাদি ভালগার মার্ক্সবাদের যুগলবন্দীতে (একে রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর) একের পর এক বিপর্যয় ঘটিয়ে এখন খুব সঙ্গত কারণেই গঙ্গাপ্রাপ্তির অপেক্ষায়।

No comments: