Tuesday, September 7, 2010

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ

তিন

পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনায় যে অবধারিত প্রশ্নটি উঠবে, সেটি হল খামখা এই বিষয়ে সময় নষ্ট করা কেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই, আমাদের এক বন্ধু সম্প্রতি ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন। আমাদের শিক্ষাবিস্তার, আমাদের রেনেসাঁস, আমাদের বামপন্থা (ভালগার বা আঁতেল) আমাদের শিখিয়েছে আন্তর্জাতিক হতে। বু্দ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন সাংস্কৃতিকভাবে বাংলা ইউরোপের একটি অংশ। অতিশয়োক্তি, কিন্তু এ থেকে আমাদের পশ্চিমমুখি মনন ধরা পড়ে (এবং সেই পশ্চিমমুখি চিন্তন ও ভাবান্দোলনের সুফল কেউ অস্বীকার করে না)। অনেকটা সেকারণে উচ্চবর্নের বাঙালি হিন্দু নিজের আইডেন্টিটি নিয়ে কি করবে, খাবে না মাথায় দেবে, ঠিক নিশ্চিত নয়। এবং সাধারণভাবে সে বাংলায় প্রচুর ইংরেজি শব্দের মিশেলে স্বস্তিবোধ করে। এ জন্য আমাদের কিছু সমস্যাও হয়। বাংলাদেশের কেউ কেউ আমাদের বাংরেজি দেখে ক্ষেপে গিয়ে ভাবেন চালবাজি করছি, আসলে যে এভাবেই আমাদের শিক্ষিতদের সিংহভাগ কথা বলেন, তা তারা জানেন না।

প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বাংলাদেশি বাঙালিদের জাতীয়তাবাদ আমাদের বিবেচ্য নয়। ইতিহাসের ঘটনাবহুল নিয়মে উচ্চবর্নের বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান এলিট বাংলাদেশকে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। পূর্ব অংশটি হয় পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম অংশটি পরিচয় পায় পশ্চিমবঙ্গ বলে। এরপর পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামটা দখল করে নেয়, এবং এই দেশটির ভিত্তিই হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ। পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারটা কিরকম হয়েছে, দেখা যাক। এবং সলতে পাকাতে হবে আবার।

বাঙালি হিন্দু উচ্চবর্ণ। বৌদ্ধধর্মকে, এবং বাঙালির স্বকীয়তাকে নষ্ট করে ক্ষমতায় আসা সেনবংশের ধামাধারি। উত্তরভারত থেকে আসা, অন্তত কিংবদন্তি সেই উৎসকেই উদযাপন করে। সঙ্গে করে আনা সনাতনধর্মের যাবতীয় বর্ণভেদ। যেহেতু ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ বাঙালিই ছিলেন না, প্রাথমিকভাবে বাংলার প্রতি, বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির প্রতি তাদের অবজ্ঞা ও দেবভাষার প্রতি তাদের ভক্তি থাকাই স্বাভাবিক। বাংলা বহুদিন আর্যাবর্ত্মের কাছে ব্রাত্য ছিল। এখানে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। বৌধায়ন বলেছিলেন বাংলায় অসুরভাষা বলা হয়। এ থেকে অনেকে অনুমান করেন, বাংলায় দীর্ঘনাসা নর্ডিক আর্যরা আসেননি, যেমনটা উত্তরভারতে হয়েছিল। হয়ত এখানে গোলমুণ্ড অ্যালপাইন আর্যরা এসেছিলেন, যারা বেদ মানতেন না (সুর বনাম অসুরের যে দ্বন্দ্ব পুরাণে দেখি)। এমনও হতে পারে আর্যরা পুর্বভূমি স্মৃতি সঙ্গে করে আনেন, এবং অন্যান্য অবৈদিক আর্যদের সঙ্গে তাদের যে দীর্ঘ লড়াই, যার ফলশ্রুতিতে সম্ভবত তারা পূর্ব ইউরোপ/এশিয়া মাইনর ছাড়েন ( একটা আকর্ষণীয় বিষয় হল, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় অনেকগুলি নদীর নামে -দনু রুট পাওয়া যায়, দানিয়ুব, দনীপার, দন, দনীয়েস্টার। খুব সম্ভবত দনুজ-দানব নামক অবৈদিক আর্য ট্রাইবটির কাছে পরাস্ত হয়ে বৈদিক আর্যরা এদিকপানে আসেন), তা তাদের ভবিষ্যৎ শত্রুদের নামকরণেও ছাপ ফেলে। তাই ভারতে এসে হয়ত তারা দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতিগুলিকে অসুর, দানব রাক্ষস ইত্যাদি মধুর সম্বোধনে ভূষিত করেন। কাজেই বাংলার ভাষাকে ঠিক কেন অসুরভাষা বলা হয়েছিল, জোর দিয়ে বলা যায় না। এটা ঠিক যে বাংলা ও গুজরাটের উচ্চবর্ণের মধ্যে কিছু শারীরিক সাদৃশ্য আছে, এবং উভয় জায়গার ভাষাতে ও-কারের বাহুল্য। অনেক ঐতিহাসিক বলেন এই দুই প্রদেশে প্রথম যে আর্যরা আসেন, তারা অবৈদিক অ্যালপাইন। ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ মনে করেন যে বাঙালি উচ্চবর্নের মধ্যে বৈদ্য নামক বর্ণটি ওই অ্যালপাইন আর্যদের অবদান। তবে ব্যপারটা কনজেকচার। অন্তত গুজরাটিদের মধ্যে বৈদ্য নামক কোনও বর্ন এটি গ্রাহ্য হত, তবে আমার গুজরাটি বন্ধুদের জিগ্যেস করে জেনেছি যে এমন কোনও বর্ন সেখানে নেই। বরং এটা বেশি যুক্তিগ্রাহ্য যে বৈদ্যরা ছিলেন বৌদ্ধ শ্রবণ, স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারির কাজ করতেন, এবং সনাতনধর্মের পুনর্জাগরণে এরা তার অংশীদার হতে রাজি হয়ে যান, ও ব্রাহ্মণ কায়স্থের পরেই জায়গা পান (বর্তমানে এরা ব্রাহ্মণের পরেই আছেন, এমনটা কিন্তু চিরকাল ছিল না)।

অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র সুহ্ম, এই পাঁচটি পূর্বভারতীয় জনজাতির কথা পুরাণ বলছে। নামগুলি অস্ট্রিক, ঐতিহাসিকরা বলছেন। পুরাণ এই নামগুলিকে দ্রাবিড় মহাসম্রাট বলির উত্তরাধিকারিদের সঙ্গে যুক্ত করে। অর্থাৎ আমাদের উৎস অনার্য। অ্যালপাইন আর্যরা যদি এসেও থাকেন, বৈদিক নর্ডিক আর্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায় ছিল এমন ভাবা ভুল হবে না (তাই দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা না গড়ে উঠলে সেটাই হবে আশ্চর্য ব্যাপার), তাই বাংলা এবং পূর্বভারতে যে শক্তিসমূহ মাথা তোলেন, যাদের বীরত্বের কথা শুনে আলেকজ়ান্ডার ভারত-অভিযান পরিত্যাগ করবেন, যারা বেদবিরোধী, নিরীশ্বর, প্রায় প্রোটো-কমিউনিস্টিক বৌদ্ধধর্মকে বরণ করে নেবেন ১৬০০ বছরের জন্য (ভৌগলিকভাবে যে অঞ্চলকে আজ বাংলা বলি, সেখানে সবথেকে বেশি সময় থেকেছে বৌদ্ধধর্ম। সনাতন ধর্ম ও ইসলাম মেরেকেটে হাজার বছর পার করেছে কি করেনি), তারা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বিপুল শক্তিশালি একটি polity ছিলেন। আজ শিডিউল্ড কাস্ট হিসেবে গণ্য হওয়া পৌণ্ড্ররা আমাদের শাসক ছিলেন, আমাদের প্রতিরোধের ঐতিহ্য ছিল, আগে ডোম বাগে ডোম ঘোড়াডোম সাজে (আগডুম বাগডুম বলে যে ছড়াটিকে আমরা চিনি, এবং যা আজ আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাছে আগডুম বাগডুম, কোনও কিছুর মানে না বুঝলে বা gibberish মনে হলে আমরা বলি আগডুম বাগডুম) নামক প্রবাদের ডোম বা চাঁড়ালরা আজ নমশূদ্র বলে পরিচিত, তারা আমাদের বীর পূর্বজ ছিলেন। আমি এই লেখায় কিছুটা বাষ্পনয়নে দুহাত তুলে আমার প্রাক্তন সেনাপতি ও সম্রাটদের জয়ধ্বনি দিচ্ছি ও অভিবাদন জানাচ্ছি। গ্রহণ করুন। আমি আপনাদেরই উৎস বলে মানি, আমি আপনাদের আনুগত্য স্বীকার করি। আমি মনে করি আপনারাই আমার জাতিকে গড়ে তুলেছিলেন। সেনরা এসে যখন বর্ণভিত্তিক সনাতনী ব্যবস্থা চালু করলেন, তখন নমশূদ্রদের সবথেকে নিম্নস্তরে নামানো হয়েছিল। ব্যাপারটা আশ্চর্যের, নীহাররঞ্জন রায় বলছেন। তবে এও আন্দাজ করেছেন যে এর মূলে কোনও গূঢ় ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে আছে। আমার ব্যাখ্যা ওপরে দিলাম। এইসময় একইভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সোনার বেনেদেরও কাস্ট হায়ারার্কিতে নিচে নামানো হয়।

চর্যায় যে বাংলাভাষার জয়যাত্রা, সেন আমলে তা থমকে যাবে, এবং সংস্কৃতচর্চা শুরু হবে। এবং বাঙালি ব্রাহ্মণ কায়স্থরা তখন বাংলায় সনাতনধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটাবেন, সমস্ত বাঙালিসমাজকে জাতপাতের নিগড়ে বাঁধবেন।। এরা ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার, ক্ষমতার এজেন্ট হওয়ার বিদ্যায় নিজেদের ভালমত গড়েপিটে নেবেন। শুরু হবে হাজার বছরের জাতপাতভিত্তিক বাঙালি বর্ণহিন্দু সমাজ, যার সমাজপতিদের মুখ পশ্চিমে ফেরানো, যাদের নিজস্ব মাতৃভাষা থাকবে না, ক্ষমতার ভাষাই হবে তাদের ভাষা। এরপর ইসলাম রাজধর্ম হবে, এবং পারসীক হবে রাজভাষা। অতি দক্ষতায় বাঙালি উচ্চবর্ণ, বিশেষ করে কায়স্থরা পারসীক শিখে নেবেন, এবং আবার ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি চলে আসবেন, ক্ষমতার দালাল হবেন। যদিও এই সময়েই একটা দেশজ, লোকায়ত সংস্কৃতির পোষণের চেষ্টা চলবে, মূলত সনাতনধর্মকে বাঁচানোর তাগিদে।
চারটি বেদে শূদ্র ও নারীদের অনধিকার ছিল। পঞ্চমবেদ বলে কথিত মহাভারত ছিল সেযুগের জনপ্রিয়তম কাব্য, মহাভারত যে শুরু হয়েছিল ব্যালাড হিসেবে তার প্রচুর প্রমাণ আছে। তা গীত হিসেবে ছিল বিনোদনের এক অপূর্ব মাধ্যম (একই কথা রামায়ণ সম্পর্কেও বলা চলে)। তাই মহাভারতকে শূদ্রের জন্য, নারীর জন্য নিষিদ্ধ করা যায়নি, স্রেফ অসম্ভব ছিল বলে। এই জনপ্রিয় গাথার নায়ক কৃষ্ণকে বহু আগেই বিষ্ণুর অবতার বলে সনাতনধর্ম আত্মীকরণ করেছিল, যদিও মহাভারত আর্য অনার্যের মিশ্রণের এক চমৎকার উদাহরণ এবং চরিত্রগুলির সকলেরই প্রায় জন্ম সম্বন্ধীয় গোলযোগ আছে, কেউই খাঁটি আর্য নন। কৃষ্ণ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ (ব্যাসদেব) জন্মগতভাবেই অনার্য, একজন যাদব অন্যজন দাসবংশজাত।
এখানে কথা প্রসঙ্গে বলি, সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্বেও, আর্যাবর্ত্ম ও সনাতন ধর্ম আমাদের আংশিক অতীত, যেভাবে প্রাচীন গ্রীস ও রোম ইউরোপের উৎস। একে কোনও বালখিল্য প্রগতিবাদিতায় যেন নস্যাৎ না করা হয়। ইতিহাস অস্বীকার করলে শুধু পুঁজির সুবিধা, শাসকের সুবিধা, এমনকি হিন্দু মৌলবাদিরও সুবিধা, যেন ভুলে না যাই।

সে যাই হোক, এই দুই মহাকাব্যের নায়ককে ভগবান বানিয়ে আর্যাবর্ত্মে (বাংলাকে এই সময় থেকে আর্যাবর্ত্মের উপনিবেশ হিসেবেই ধরতে হবে) এক লোকায়ত ধর্ম প্রচলনের চেষ্টা মধ্যযুগে দেখা যায়। বেদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থগুলি ছিল উচ্চবর্ণের এক্সক্লুসিভ সম্পত্তি, কাজেই তা এইসময় থেকে মোটামুটি বেকার হয়ে পড়ে। এইসময় শুরু হয় ভক্তি আন্দোলন, বাংলায় যা জাতপাতের সমস্যা কিছুটা মেটাবে, এবং polityর গণতন্ত্রীকরণ ঘটানোর দিকে এক নিশ্চিত পদক্ষেপ নেবে। বৌদ্ধধর্মের অবলুপ্তিতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা যেন বাংলার বৈষ্ণব আন্দোলন সারাতে চেয়েছিল, এবং চৈতন্যকে মনে হয় মধ্যযুগের বুদ্ধ। জ্ঞানের জায়গা নিয়েছিল ভক্তি, কিন্তু লোকায়তজনের ক্ষমতায়ন ছিল উভয়েরই ধ্রুব লক্ষ্য।
বাংলার অন্যান্য গাথাগুলি এসময় লিপিবদ্ধ হতে শুরু করে মঙ্গলকাব্য হিসেবে, লোকায়ত ও ব্রাত্য দেবদেবীরা চিরকালই অন্ত্যজদের জীবনের মূলের কাছাকাছি ছুঁয়ে থাকেন, এবার তারা সনাতনধর্মের প্যান্থিয়নে চলে আসবেন। এই সময় বাংলার সনাতনধর্ম এক নবরূপ ধারন করে, এবং একে কোনওমতেই সেই কিংবদন্তির আদিশূরের বর্ণভেদমূলক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বললে চলবে না। বৌদ্ধধর্মের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য এই হিন্দুধর্মে মিশে থাকবে, যেভাবে ব্রিটিশ সমালোচক রেমন্ড উইলিয়ামস দেখিয়েছিলেন residual cultural forms গুলি dominant cultural forms এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে। আজ বাংলায় যে হিন্দুধর্ম আমরা জানি, বোষ্টম-বাউল-সহজিয়া-শাক্ত মিশ্রিত এই ধর্মের লোকায়ত চেহারাটি কিন্তু সনাতন ধর্ম আদপেই নয়।

কিন্তু সমাজ শাসন করছেন যারা, তারা ক্ষমতাকেন্দ্রেই থাকবেন। সৈয়দ মুজতবা আলি চমৎকার দেখিয়েছিলেন যে বাংলা ভাষা পারসীক সিনট্যাক্স অনুযায়ী লিখিত হয়ে আসছে, সংস্কৃত সিনট্যাক্স অনুযায়ী নয়। কায়স্থরাই সেযুগে পেশাদার লিপিকার ছিলেন, যাকে বলে scribe। ব্রাহ্মণরাও মুসলিম শাসকদের চাকুরিগ্রহণে খুব পিছিয়ে ছিলেন না, তবে কায়স্থদের মত এত উন্নতি করে উঠতে পারেননি। কায়স্থরা পারসীক শিখতেন প্রায় নিজের মাতৃভাষার মত, আজ যেভাবে বাঙালি বর্নহিন্দু ইংরেজি শেখে এবং বলে প্রায় মাতৃভাষার মত (এবং এও বলা হয় যে বঙ্কিমের সময় থেকেই বাংলা গদ্য ইংরেজি সিনট্যাক্সের অনুসারী হয়ে ওঠে)। আমরা comprador, আমাদের ভাষাতেও তার ছাপ রয়েছে।

No comments: