Sunday, February 13, 2011

প্রেম

রামকৃষ্ণও নরেনকে গান গাইবার জন্য ঈঙ্গিত করলেন। আজ গুরু বেশ সুস্থ আছেন, তাই শিষ্যরা সকলেই উৎফুল্ল। নরেন গান ধরলঃ
প্রভু ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম তেরা
তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, তু দেওয়ান মেরা।
দো রোটি এক লঙ্গোটি, তেরে পাস ম্যয় পায়া
ভগতি ভাব আউর দে নাম তেরা গাঁবা...
এর পর সে গাইলঃ
নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী...

গান শুনতে শুনতে মহেন্দ্রলাল এক দৃষ্টিতে রামকৃষ্ণের দিকে চেয়ে রইলেন। এক সময় রামকৃষ্ণ বিছানা ছেড়ে নামলেন মেঝেতে, হাত তুললেন নাচের ভঙ্গিতে। অন্য দিন হলে মহেন্দ্রলাল প্রবল আপত্তি জানাতেন, সামান্য পরিশ্রমেই রোগ বেড়ে যাবার সম্ভাবনা। আজ কিন্তু কিছুই বললেন না। একটু নাচতে গিয়েই রামকৃষ্ণের ভাব সমাধি হল সামান্য সময়ের জন্য।
ডাক্তারের চক্ষু দিয়ে জল গড়াচ্ছে। গলার কাছে যেন আটকে রয়েছে কিছু। তিনি রুমাল বার করে মুখ মুছলেন।
স্বাভাবিক হয়ে রামকৃষ্ণ বললেন, ও কি গো, তুমি কাঁদছ নাকি?
মহেন্দ্রলাল বললেন্‌ ভাল গান শুনলে আমার বুকের ভেতরটা মোচড়ায়।
রামকৃষ্ণ কাছে এসে বললেন, তবে তো তোমার হয়ে এসেছে গো, তুমি মজেছ! আমায় থ্যাঙ্ক ইউ দাও!
মহেন্দ্রলাল ধরা গলায় বললেন, সে কথা কি তোমাকে মুখে বলতে হবে? আমি সামান্য ডাক্তার, তোমার কাছে এসে কত কী শিখলাম!
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম আলো)


রাজনীতি না করলে এই প্রজন্মের ছেলেকে দিয়ে সামাজিকতা করানো বেশ মুশকিল। আমি আসলে বেশ অসামাজিক। বউ আর বই নিয়েই সবথেকে ভালো থাকি, আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক পাপাচার, যেমন গান, সিনেমা, গড়গড়া (হ্যাঁ, আজকাল একটা আলবোলা টেনে থাকি), আর ইন্টারনেট, ব্যস। কিন্তু যেদিন থেকে শিক্ষক রাজনীতিতে এসেছি, চাই বা না চাই, সবার সঙ্গে খেজুরে করে, এবং দরকারি লোকেদের সঙ্গে দহরম করে সময় ব্যয় করতে হয়। যদিও কুঁড়ে, তবে হাতে গোনা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আমন্ত্রণ ফেলা যায় না। একটি নিমন্ত্রণ রক্ষায় যেতে হল একটি কলেজে, তবে আমি যেমন খচ্চর, সেমিনার কাটিয়ে দিয়ে, একটি ডকু প্রদর্শন এড়িয়ে, সুফি গানের অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগে গিয়ে পৌঁছলাম। ভাবলাম, যাই হোক, গান তো শোনা যাবে। গিয়ে দেখি, ডি ইউ টি এর সেক্রেটারিও এলেন। তিনি অবশ্য হাত টাত মিলিয়ে, মিনিট পাঁচেক গদিতে পশ্চাতদেশ ঠেকিয়ে সরে পড়লেন। একটি সুফি ব্যান্ড পারফর্ম করছিল। শুনতে থাকলাম।
শুনতে শুনতে ঘোর লাগতে লাগল। অসাধারণ বললে কম বলা হয়। কি উদ্দীপন, কি ভীষণ এক প্রেমের যুদ্ধঘোষণা মানুষের সব পরাজয়কে তুচ্ছ করে, মৃত্যুকে অতিক্রম করে, সেই আবেগ যা মানুষকে লহমার মধ্যে চিরন্তনকে ছুঁতে দেয়, অথচ যা নিবিড়ভাবে, তীব্রভাবে শরীরী, যা এই জগতের ধুলোকাদা মাখা সব আবিলতার মধ্যে মিশে থাকা এক চিমটে ঈশ্বরবিন্দু, এমন আকুলতা যার সঙ্গে বাউল, বোষ্টম, সুফি রা আত্মনিবেদন করেন, সেই সব মিলেমিশে আমাকে কতবার আবিষ্ট করল, মনে হল কয়েকবার মরলাম আর পুনর্জন্ম হল। মনে হচ্ছিল বেশিক্ষণ হৃদয় ও মস্তিষ্কের এমন মস্তি ও অর্গাজ়ম সহ্য করা বেশ কঠিন। কখনও খাজা মইনুদ্দিনের প্রতি প্রবল আকুতি, আমাকে গ্রহণ কর, কখনো সেই আকুতি ফিরে যাচ্ছে প্রেমিকার প্রতি, কবির নিজস্ব ঈশ্বরীর প্রতি, আ যা পিয়া, না যা পিয়া, ফিরে এস, ফিরে এস, তুমি জিতেছ, আমি হেরে গেছি, এই তো স্বীকার করলাম, ফিরে এস। এই দেখুন, এখনও লিখতে গিয়ে চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে... কখনও রাধা বলছেন, ও যেন ওর রঙে আমায় রাঙিয়ে দেয়, আর ধোপারা সারা জীবন ধুলেও সেই রঙ উঠবে না। কখনও মাতাল ও পাপাচারী কবি বলছেন, আমি যেখানে পড়ে আছি, ফেরেশ্তা সেখানে আসেন না, কিন্তু আমি জানি তুমি আমার জন্য আসবে। এরপর বুল্লে শাহ বলছেন, না না, ঈশ্বরের অভিমান নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না, সে লোক তো সামান্য প্রার্থনা শুনলেই জল হয়ে যায়, কিন্তু যা সবথেকে কঠিন সেই কাজটা কর, আগে বান্ধবীর মান ভাঙাও। এঁরা প্রাণ দিয়ে, শরীর দিয়ে, কলিজা দিয়ে গাইছিলেন ও বাজাচ্ছিলেন, মাঝে দেখলাম আমার শুনতে এত অসহ্য লাগছিল, ওরা গাইছেন কি করে? গায়কদের মনে হচ্ছিল দিব্যোন্মাদ, একটা গান তো সরাসরি ঘোষণা করল, আমরা দিওয়ানা, আমরা ধর্মের কুটকচালি কি বুঝব, ওসব তো মোল্লা আর ব্রাহ্মণদের জন্য, ওরা আল্লাকে কাবা আর ভগবানকে কাশীতে বন্দি করে রাখে, আমরা দেখ শুধু এই উপাসনা জানি, এর নাম প্রেম।
এখন ব্যাপারটা হল, এই সুফি তো সেই ঈশ্বরের ভাষা, যার কথা এখন ঈগলটন ওঁর মত করে বলার চেষ্টা করছেন। জীবনের অর্থ যে ভালবাসা, এবং মৃত্যুকে জয় করতে পারে শুধু সে-ই, এবং মানুষ হয়ে মানুষকে প্রবলভাবে ভালবাসাই তো সাম্যের প্রধান ইন্ধন। সাম্য মানে তো ভক্তি আন্দোলন, তার মানে তো চৈতন্য, তার মানে তো মস্ত কলন্দর, তার মানে তো মানুষপুত্র যীশু, আর মহম্মদও সেই ভালবাসার কথাই বলছেন সুফি সাধকদের মতে। কিভাবে এমন ঈশ্বর-উপাসনা ওয়াহাবি নামক লগুড়ধারি গোরিলার কাছে হেরে যেতে পারে, এবং যদি হেরে যায়, তখন, ঈশ্বর নিজেই যে পরাভূত!
চৈতন্যের আন্দোলন কি রকম ভাব উচ্ছাস তৈরি করেছিল, তার বর্ণনা পড়েছি। নামগান ঠিক কিভাবে সবাইকে নাচাত, সেটা এই সুফি ব্যান্ডের অনুষ্ঠান দেখে টের পেলাম। কেসটা রীতিমত জন্ডিস। আর এরা যেন আমার মনের ভাব টের পেয়েই দমাদম মস্ত কলন্দর গাইতে গাইতে টুক করে হরিবোল হরিবোল বাজিয়ে দিলেন ব্যাকগ্রাউন্ডে। ধ্যাত্তেরি, শালা, মনে হচ্ছিল এইবার সমস্ত অপ্রেমকে টুসকি মেরে আমিও নাচতে লেগে যাই। আমার বন্ধুটি, তিনি ওই কলেজে ইতিহাস পড়ান, নাচছিলেন। আমি বাঙালি ভদ্রলোক কিনা (মনসুন ওয়েডিং ছবিতে এই সংক্রান্ত একটি ডায়ালগ ছিল, মনে পড়ছে), তার ওপর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মেম্বার, তাই নাচতে লজ্জা হল। নাচিনি, তবে চোখের জল এইভাবে কন্ট্রোল করা যায় না, হাত পা যেভাবে খানিকটা বশে রাখা যায়।
পৃথিবীর মুক্তি প্রেমে। মানুষের মুক্তি মার্ক্স যে কিছু বিমূর্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে খুঁজেছেন, তার কারণ ওঁর সময়ে এনলাইটেনমেন্ট প্রজেক্ট শেষ হয়নি। মার্ক্স ভয়ানক ভুল করেছেন তাও বলা যায় না। গায়ক এক জায়গায় ভণলেন, এক বাদশা এক সুফি সাধককে বলে পাঠিয়েছিলেন, আমি দুনিয়ার মালিক, কিন্তু আমি আপনার অনুরাগী, আমি আপনার দরগায় আসব। সেই সাধক উত্তর দিয়েছিলেন, দেখুন, দুটো দরজা আছে আমার দরগায়। আপনি যে-ই একটা দরজা দিয়ে ঢুকবেন, আমি অন্যটা দিয়ে বেরিয়ে যাব। সুফির সঙ্গে ক্ষমতার আপস নেই।

এই বিপ্লব অসমাপ্ত রয়েছে, এই বিপ্লবকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া আমাদের কাজ। আর ভুল করবেন না, এর মানে কিন্তু কোনও বিমূর্ত বিশ্বজনীনতা নয়। সুফি ভীষণ পার্টিকুলার, ভীষণ কনক্রিট, মেটেরিয়েল, সুফি কে পেতে হলে একটি নির্দিষ্ট মাধ্যম চাই। আপনি যেমন শরীরী প্রেম করতে গেলে একটি মানুষকে করবেন, বিশ্বমানবের সঙ্গে সেটা সম্ভব নয়। সুফির প্রেমের মাধ্যম তার ভাষা। এঁরা যেমন পারসীক, পাঞ্জাবি, হিন্দভি, ব্রজ বিভিন্ন ভাষায় গাইলেন। পারসীক ভাষায় সেই বিখ্যাত প্রেমের মন্ত্র, তু মন শুদি, মন তু শুদম, মন তন শুদি, তু জাঁ শুদম, তুমি আমি হলে, আমি তুমি হলাম, আমি শরীর হলাম, তুমি প্রাণ হলে, তা যেমন সব মানুষকে আচ্ছন্ন করে, তেমনই মনে করিয়ে দেয়, প্রেম আসলে শরীর ও ভাষার মত, নির্দিষ্টকে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয়। মানুষ লিঙ্গুইস্টিক প্রাণি। বিশ্বজনীনতা আসে আমার বাঙালিয়ানাকে আশ্রয় করে, বাঙালিয়ানা-বিহীন বিশ্বমানবতা যারা কল্পনা করেন, তাঁরা জানেন না, তারা একটি নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যবাদি মতবাদের ধারক।

No comments: