Sunday, February 13, 2011

ঘৃণা

একবার দিল্লির একটি কলেজ জুড়ে প্রবল গুজব ছড়াল, শ্রী অমুক ঝা এইবার ভাইস প্রিন্সিপাল হচ্ছেন। সেই লোকটি সম্পর্কে যারা অবহিত ছিলেন, তারা সবাই বেশ অবাক। ভদ্রলোক হচ্ছেন, যাকে এদেশের ভাষায় বলে চম্পক। গুড ফর নাথিং, নিজে একবার রটিয়েছিলেন যে উনি খুব শিগগির ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তবে তার আগে সুপ্রিম কোর্টের জজসাহেব হওয়ার আশু সম্ভাবনা (বিহার থেকে আইনের একটি ডিগ্রি বাগিয়েছিলেন একদা), এক জ্যোতিষী নাকি ওকে হাত দেখে বলেছে। কাজেই সবাই খোঁজাখুঁজি করে দেখলেন যে এবারও গুজবের মূল সুত্রটি উনি নিজেই, উনিই ছড়িয়েছেন।

সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, সিপিএম নাকি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। প্রবল গুজব বাজারে। দিল্লি অবধিও পৌঁছে গেছে। সিপিএম বিরোধি বিকল্প বাম মঞ্চের একজন পাঞ্জাবি শিক্ষক নেতা আমায় শুধোলেন, সিপিএম নাকি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে? আমি জিগ্যেস করলাম, কোথথেকে জানলেন? জানা গেল, সিপিএম এর একজন ওঁকে বলেছে।

১২ই ফেব্রুয়ারি রাতে স্টার আনন্দ একটি ভিডিও ক্লিপিং দেখায়। হলদিয়ার প্রাক্তন এম পি লক্ষণ শেঠ কে দেখা যাচ্ছিল। একদল মানুষ তাকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, তিনি গাড়িতে বসে বলছেন, এই চুপ, তোমরা তৃণমূল, এ-এ-এই, এক মারব, তিনি মারার জন্য হাত তুলে বোঝালেন, যে কিভাবে মারবেন। এক দরিদ্র মহিলা, সম্ভবত পুলিস ও হার্মাদের হাতে পিটুনি খেয়েছেন, তাঁর একটি বাচ্চা ছেলে আছে, তার হাঁটুতে দগদগে একটা ক্ষতচিহ্ন, লক্ষণ সেই মহিলাকে বললেন জল্লাদ, এবং সেই মহিলা চিৎকার করে বলছিলেন, যে তারা একসময় লালঝান্ডা নিয়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ করেছেন, তখন তো জল্লাদ বলা হয়নি।

সিপিএম এর লোকেরা ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সর্বত্র বলে চলেছে তৃণমূল আর মাওবাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। সিপিএম এর বিরোধিতা করলে এ দুটোর একটা নির্ঘাত না হয়ে যায় না, এমনকি দুটোই হতে পারে। এবং গোয়েবলসীয় কায়দায় এক কথা হাজার বার বললে যেমন হয় আর কি, অনেকেই এটা খেয়ে ফেলেছেন। যেটা পশ্চিমবঙ্গবাসি মাত্রেই জানেন, মাওবাদিরা একদম মাইক্রোস্কোপিক সেখানে, এখনও পর্যন্ত, তবে যে কায়দায় সিপিএম নন্দীগ্রামে ও লালগড়ে সূর্যোদয় ইত্যাদি ঘটিয়েছে তাতে মাওবাদিদের সামনে বা যারাই হিংসার রাজনীতি করেন তাদের জন্য একটা বড় সুযোগ এসে গেছে, কারণ সিপিএম প্যাঁদানি ছাড়া আর কোনও ভাষা বোঝে না, আর যারা লাথের ভুত, তারা বাতে মানবে কেন, তাই সাধারণ মানুষ আজকাল সিপিএম মরলে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন। বিষয়টি বিপজ্জনক, এবং পশ্চিমবঙ্গের সাড়ে সর্বনাশ হওয়ার চমৎকার সম্ভাবনা এতে গভীরভাবে প্রোথিত আছে।

সিপিএম কে তৃণমূল হারাচ্ছে না। তৃণমূলের নিজস্ব শক্তি সংগঠন যা আছে, তার কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। সিপিএম কে হারাচ্ছে সিপিএম থেকে বেরিয়ে আসা মানুষেরা। যারাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা এটা জানেন।

লক্ষণ শেঠ এর ক্লিপিং এ আরো বাকি ছিল। দেখা গেল এবার দৃশ্যান্তর। নেতা এখন একটি ভবনের ভেতরে, একদল বিক্ষোভকারির সামনে গর্দভবিনিন্দিত গলায় এবার নেতা হুমকি দিচ্ছেন, এ-এ-এই! কে? কে বলল হার্মাদ? তোরা হার্মাদ, তোরা জল্লাদ, তোরা তৃণমূল। আস্ফালন করছেন, এমন মারব না!

আবার দৃশ্যান্তর। এবার রামানুজ বলছেন, এরা নৈরাজ্যবাদি, সুতরাং হচ্ছে (সিপিএম এর বিমান বসু থেকে, বিনয় কোনার থেকে, নিরুপম সেন থেকে পুঁটি নেতা পর্যন্ত সবাই এই "হচ্ছে" শব্দটা মুদ্রাদোষ হিসেবে ব্যবহার করেন, রেজিমেন্টেশন কাকে বলে তা এদের দেখলে টের পাওয়া যায়, দিল্লিতে গোপালন ভবনে বসে ইয়েচুরি যা বলছেন, তা হুবহু সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে পার্টির নেতা কাম প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার বমি করে দেন) এই সব জল্লাদদের মানুষ দেখে নেবে।

আমরা, মানে আমি ও আমার স্ত্রী একবার হলদিয়ায় গেছিলাম। তখন চাকরি খুঁজছি। ওখানে লক্ষণবাবুরা শিক্ষার ভাল বেসাতি করেন, Icare নামে একটা কম্পানি খুলেছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ম্যানেজমেন্ট কলেজ, ল কলেজ, কি নেই...আমরা ইন্টারভিউ দিলাম, বলা হল নির্বাচিত হয়েছি, জানতে চাওয়া হল কবের মধ্যে জয়েন করতে পারব, আমরা বললাম একটু ভেবে দেখার সময় চাই, সত্যি বলতে গেলে কি, কলকাতা থেকে এত দূরে, এত প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে প্রচুর ঢক্কানিনাদ সত্বেও উন্নয়ন প্রায় কিছুই হয়নি, একজায়গায় চলতে চলতে বাসের কন্ডাক্টর ঘোষণা করেছিল, সিটি সেন্টার, সিটি সেন্টার, সেখানে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, একটা ধু ধু মাঠ, কয়েকটা গরু চরছে ইতস্তত, এরকম জায়গায় যাওয়াটা বেশ কঠিন।

ফিরে এলাম, বললাম, দিন দুয়েকের মধ্যেই জানাব। তা আমরা কিছু জানানোর আগেই, ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর ফোন করে বললেন, আমাদের এসে আরেকবার ইন্টারভিউ দিতে হবে। কেন? না আগেরবার লক্ষণ শেঠ ছিলেন না, উনি নিজে একবার ইন্টারভিউ নেবেন, তারপরে চাকরি পাকা হবে। ভাবুন, আমাদের ইন্টারভিউ নেবে লক্ষণ শেঠ! বলা বাহুল্য, এই প্রস্তাবের উত্তরে কয়েকটি কাঁচা খিস্তি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, তখনও বেঙ্গলে থাকি, তাই বিনীতভাবে আমাদের অসহায়তার কথা জানিয়ে হলদিয়ায় না যেতে পারার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলাম।

এটা সত্যি ঘটনা। আরেকটা ঘটনা যেটা ঘটতে চলেছে, সেটা বলে রাখি, সিপিএম এর নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ বিধানসভা নির্বাচনে ওদের পার্টি হেরে ঢোল হওয়ার পরে বাংলা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবেন, কারণ মানুষের ঘৃনা যে জায়গায় পৌঁছেছে, ওদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি জ়েড ক্যাটিগরিতেও নিশ্চিত করা যাবে না। ওরা লিঞ্চিং এর শিকার হতে পারেন, কারণ, মানুষ ওদের আর সহ্য করতে পারছেন না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, স্টার আনন্দের ক্লিপিং এ লক্ষণের আস্ফালন দেখতে দেখতে আমারই হাত নিশপিশ করছিল, মনে হচ্ছিল ডাস্টার দিয়ে মেরে মেরে ওর মাথার ঘিলু বার করে দিই। মানুষের এত ঘৃণা, এত অভিশাপ মাথায় নিয়ে এই ফ্যাসিস্টরা কোথায় পালাবে, আর যখন এদের রথের চাকা বসে যাবে, কোন ন্যানো-আকাঙ্ক্ষী, সেক্টরফাইভ-গামী, আজকাল ও গণশক্তি পড়া সরকারি অফিস-স্কুল-কলেজ এর চাকুরিজীবি এদের দেহ-রক্ষা করবে?

No comments: